বুধবার, ১৯ মে, ২০২১

শিশুভোলিউশন

 শিশুভোলিউশ্ন্

(শিশুদের অনুনাটক)


চরিত্র

  • কথক
  • বাঁদরদল (বাঁদরের সাজে চার-পাঁচটি বাচ্চা)
  • রাধা
  • পুঁটি
  • পল্টু
  • নেপাল
  • বাচ্চা ১
  • বাচ্চা ২
  • বাচ্চা ৩
  • বাচ্চা ৪
  • রোবো
  • রোবো
  • রোবো
  • রোবো
  • রোবো

 

(মঞ্চসজ্জা- মঞ্চের পেছনেইভোলিউশন্অফ্মানকাইন্ডএর একটি কার্টুন চিত্র যেখানে বাঁদর  থেকে রোবটে ইভোলিউশন্আঁকা মঞ্চের মাঝে চারটি গাছ একত্রে দাঁড়  করানো অন্ধকার ধীরে ধীরে আলো জ্বলে)


কথক - পৃথিবী পরিবর্তনশীল মহাজাগতিক এক বিস্ময় আজ যাহা আছে, কাল ছিল না, থাকিবে না- এই নিয়ম আদি-অনন্তকাল হইতে চলিয়া আসিতেছে আদিকালে মনুষ্য মর্কট আছিল অবশ্য ইহা অন্য কথা যে আমাদিগের মধ্যে হইতে দু-দশ জনা কে আজও শিক্ষক মহাশয়মর্কটবলিয়া সম্বধন করিয়া থাকেন তো ইহা বলা যায় যে আগে আমাদিগের লাঙুল আছিল যাহা এখন আর নাই

(বাঁদর সাজে কিছু বাচ্চার প্রবেশ )

হ্যাঁ, তো মঞ্চে আমাদিগের পূর্বপুরুষ মর্কটমানবদিগের কিছু মর্কটশিশু আসিয়াছে দেখিয়া মালুম হইতেছে এই মর্কটশিশুরা বড়ই আমোদপ্রেমী ওই দেখুন, কেমন নাচিয়া, লাফাইয়া একে অপরের লাঙুল লইয়া টানাটানি করিতেছে; সত্যই, মর্কটই বটে; আসুন উহাদিগের বার্তালাপ শুনিয়া কিছু আনন্দ লাভ করি


বাঁদরদল- চ্যুঁ-চ্যুঁ-ক্রুট-ক্রুট-চ্যাঁ-চ্যাঁ-ক্র্যাঁচ-ক্র্যাঁচ!


কথক হা ঈশ্বর! ইহা যে দেখি মর্কটভাষা! আমি তো ইহা বুঝিতে পারি না আপনারাও নিশ্চয়ই বুঝিয়া ওঠেন নাই উহারা কি কহিতেছে তাহা হইবে না-ই বা কেন? সে যুগে তো ভাষাশাস্ত্র আবিষ্কারই হয় নাই! তবে চিন্তার কিছুই নাই, বৈজ্ঞানিকগণে উচ্চমানের যন্ত্রাদি আবিষ্কার করিয়া ইহার সুবিধা করিয়া দিয়াছেন অপেক্ষা করুন, এখনই ইহা তর্জমা করা হইতেছে


বাঁদরদল লাফাই-ঝাঁপাই-নাচি-গড়াই এ যে মজার ছেলেবেলা,

            গাছের গাছের ফল খাই আর সারাদিন শুধুই খেলা

            ডালে-ডালে ঝুলে-দুলে করি সবই একাকার,

            নেই যে কোনও চিন্তা, সবাই মোরা এক প্রকার

            এই আমাদের লেজখানি- কারও কালা, কারও ধলা,

            সত্যি খুবই মজাদার এই আমাদের ছেলেবেলা

            মজার সারা দিনটা আর মজার সারারাত,

            খিদে পেলে খাই আর খেলি, জীবনটা কেয়াবাত!


(বাঁদরদল নাচতে নাচতে গাছ চারটিকে এদিক-ওদিক সরিয়ে দেয় ও বেড়িয়ে যায় কাঁধে ব্যাগ-ঝোলা ইত্যাদি নিয়ে চারটি শিশুর একটি দল গল্প করতে করতে মঞ্চে আসে পোশাক একটু সেকেলে সাথে কথক ২ এর পাঠ শুরু)


কথক -হ্কি মজারই না ছিল জীবনটা সে সময়; খিদে পেলে খাও, খেলো আর ঘুমোও পড়াশোনার টেনশন কে যেতে দাও পেনশন নিতে কিন্তু সে সুখ আর শিশুদের রইল না, ঈশ্বর আমাদের মানুষ করে দিলেন এখন ছেলেমেয়েদের পাঠশালায় যেতে হয়, পড়তে হয়!


রাধা - এই পুঁটি, গুরুমশাই কাল যে বাড়ির কাজ দিয়েছিলেন, করেছিস?


পুঁটি - হ্যাঁ-হ্যাঁ, তা আবার করব না? বারো ঘরের নামতা, দশ পাতা হাতের লেখা, ব্যাকরদু পাতা আর-আর- ইংরিজি রাইম্স্মুখস্ত- সব হয়ে গিয়েছে


পল্টু - বাবা-রে-বাবা! গুরুমশাই কত কাজ যে দেন আর পারা যায় না!


নেপাল - আমরা তো করে নিয়েছি, কিন্তু পল্টু করেছে কি? কি রে পল্টু?


রাধা - মনে তো হয় না এইজন্যই তো গুরুমশায় ওকে বাঁদর বলে ডাকেন


সবাই - হাঃ-হাঃ-হাঃ-হাঃ-হাঃ-হাঃ!


পল্টু - অ্যাই ছাড় না এইসব, চল খেলি চল


(সবাই খেলা শুরু করে)


কথক - (বিষাদের সুরে) হ্যাঁ তখনও বাচ্চারা খেলত, মজা করতো, আনন্দ করতো পড়াশোনা ছিল, কিন্তু চাপ ছিল না; আনুশাসন ছিল, কিন্তু আনন্দও ছিল কিন্তু ধীরে-ধীরে বিজ্ঞান নিজের চমৎকার দেখানো শুরু করল


(কথকের পাঠ চলাকালীন বাচ্চারা গাছ চারটিকে মঞ্চের চার কোনে দাঁড় করিয়ে বেড়িয়ে যাবে হাতে ল্যাপটপ, মোবাইল নিয়ে চার শিশুর প্রবেশ তারা চারটি গাছের নীচে বসে অভিনয় চলা কালীন কেউ কারও দিকে তাকাবে না)


বাচ্চা ১ - আজকের হোমওয়ার্কটা কেউ শেয়ার করো তো, সাথে সলিউশান্টাও দিতে ভুলো না যেন


বাচ্চা ২ - আরে দ্যাখো-দ্যাখো, আজ রণি স্কুলে কান ধরে দাঁড়িয়েছিল আমি ফটো তুলে আপলোড করে দিয়েছি, তোমরা সবাই লাইক-টাইক তো করো!


সবাই - লাইক-শেয়ার-লাইক-শেয়ার-লাইক!


বাচ্চা ৩ - আজ স্কুলে স্যার বকেছেফিলিং ভেরি স্যাড


বাচ্চা ১ - লাইক


বাচ্চা ৪ - একটা স্ট্যাটাস দিয়ে ফেলি- ‘মনটা আমার বড়ই খারাপ


বাচ্চা ২ - লাইক


বাচ্চা ৩ - কেন, কি হল গো?


বাচ্চা ১ - শেয়ার-শেয়ার-শেয়ার


বাচ্চা ৪ - চলো একটা সেলফি হয়ে যাক


(সবাই সেলফি নেয়)


বাচ্চা ২ - পড়তে ইচ্ছেই করছে না, চলো চ্যাটিং করি সবাই


(সবাই চ্যাটিং এ ব্যাস্ত হয়ে পড়ে)


কথক - অবস্থাটা যদি এমনই চলতে থাকে, তবে ভবিষ্যতে বাচ্চারা আর মনুষ্যসন্তান না থেকে যন্ত্রকূলের সন্তান হয়ে যাবে- সেটাই হবে তাদের শিশুভোলিউশানের অন্তিম পর্যায়


(বাচ্চারা চ্যাটিং করতে করতেই বেড়িয়ে যায় যাবার সময় গাছ চারটিকে নিয়ে যায় পাঁচ রোবট বাচ্চার প্রবেশ তারা কথক এর বাচন চলাকালীন মঞ্চে এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করবে)


কথক - (যান্ত্রিক শব্দে) বাচ্চারা এখন হয়ে গিয়েছে রোবোটস্‌- নেই মনে খুশি বা দুঃখের রেশ, ইমোশানস্তো কবেই হয়ে গিয়েছে শেষ করে তারা সারাদিন শুধু কাজ-কাজ আর কাজ, করা যাবেনা আর কোনই আরাম আজ এক্সপ্রেশানের তো ছিটেফোঁটাও নেইকো কোনও, মিউজিয়াম্এ গিয়ে মনে করতে হয় ছোট্ট শিশুরা হাসতোও যে কখনও এখন তো তাদের নামও আর সোনু-মোনু-চিন্টু-রিন্টু রাখা হয়না এসে গেল ভবিষ্যৎ যুগের বাচ্চাবোটস্


রোবো ১ - হ্যালো, আমি RBX-2000, আমার আছে ৫৪ টিবি হার্ডডিস্ক, ২৫ জিবি র‍্যাম আর ১২৫ গিগাহার্টজ্‌ প্রোসেসর।


রোবো ২ - হাই, আমি GNP-191, ৭৫ টিবি মেমোরি, ৭৫ গিবি র‍্যাম আর ইন্টেল কোর ২৫ প্রোসেসর আছে আমার।


রোবো ৩ - হাই, আমি TTX-UL-01, আমার মাইক্রো সুপার কম্প্যুটার সবচেয়ে ফাস্ট। মেড ইন জাপান।


রোবো ৪ - আমি UNBT-25, আমার অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজ্‌ ৩০।


রোবো ৫ - হ্যালো, আমি KOKO-UI-391, আমার কথা কে না জানে!


সবাই - আমরা সবাই বাচ্চাবোটস্‌।


রোবো ২ – জানো দু-মাস পর আমি একটা নতুন ওয়াইফাই ডিভাইস ইন্সটল করাবো।


রোবো ৪ – আর পরশু আমাকে আপগ্রেড করা হবে।


রোবো ১ – শোনো, কারও কাছে ফিজিক্স রুলস্‌ এর ফোল্ডার এনক্রিপশনস্‌ থাকলে আমায় তা পাঠাও।


রোবো ৫ – হ্যাঁ, এই নাও।


রোবো ৩ – শোনো, কাল আমি একটা নতুন শব্দ পেলাম- খুশী। এটা ঠিক কি জিনিষ?


রোবো ১ – জানি না, আমার ডেটাবেস এ নেই।


রোবো ২ – দাঁড়াও, আমি সার্চ করে দেখছি...হ্যাঁ, এটা পুরোনো মানবদের হত...এক প্রকারের মনোভাব।


রোবো ৫ – মনোভাব…মনোভাব…সেটা আবার কি হয়?


রোবো ৪ – জানি না, হয়ত বার বার বললে পরে বুঝতে পারব।


রোবো চলো তবে, বলা যাক।


সবাই – খুশী-খুশী-খুশী-খুশী…(বলতে বলতে বেড়িয়ে যায়)


কথক – অবস্থাটা কেমন হবে যখন খুশী, দুঃখ, রাগ ইত্যাদি আমাদের কাছে অপরিচিত শব্দ হয়ে যাবে? কি হবে আমাদের তখন? সত্যিই কি আমরা সে পথেই যাচ্ছি যখন আমরা আর মানুষ থাকব না? তাই বাচ্চারা, মানুষ হয়ে যদি বাঁচতে চাও তো জাগো, কাঁচা বয়সে মোবাইল থেকে দূরে ভাগো।

 

শিশুভোলিউশন

২টি মন্তব্য: