বুধবার, ৯ জুন, ২০২১

রমণে? বুঝিবে শমনে


ছেলেবেলা থেকেই শুনে এসেছি মৃত্যুর পর আত্মাকে বিচারের জন্যে যমলোকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে তার সারা জীবনের কর্মফল অনুযায়ী শেষ বিচার হয়ে থাকে। কনসেপ্টখানা খানিকটা এরকম- মানুষের মৃত্যু হলেই বড় বড় গোঁপওয়ালা ভয়ংকর যমদূতেরা মোটা মোটা ডাঙস হাতে আত্মার দায়িত্ব বুঝে নিতে চলে আসে। যদিও তাদের কাছে কোনওরকম ওয়ারেন্ট থাকে কিনা কখনও শুনিনি, কিন্তু শুনেছি তারা আত্মাকে টানতে টানতে ছেঁচড়ে নিয়ে যায় যমালয়ে; মাঝে কোথাও চা-শিঙ্গারার টিফিন করতেও দাঁড়ায় না। যমলোক এক অতীব ভয়ের জায়গা, সেখানে সভার মাঝখানে ইয়াব্বড় পাকানো গোঁপওয়ালা যমরাজ তার সজত্নে নারিশ্‌ড গোঁপে তা দিতে দিতে আত্মাদের বিচার করেন। তার এক পাশে জাবদা খাতার পাহাড়ের মাঝে বসে থাকেন চিত্রগুপ্ত মহাশয় যার কাজ হল প্রত্যেক ব্যাক্তির পাপ-পুন্য-কর্মফল ইত্যাদির হিসেব মেনটেন করা ও আত্মাদের বিচারকার্যে যমরাজকে অ্যাসিস্ট করা। আর ঘরের এক কোণে করুণ মুখে দাঁড়িয়ে থাকেন  বিষ্ণুদুতেরা; উদ্দেশ্য- যমরাজের করা বিচারের ফাঁক গলে যদি কোনও  পুণ্যাত্মা টুণ্যাত্মা পাওয়া যায় তাকে নিয়ে বৈকুণ্ঠলোকে সাপ্লাই করা। যমলোকের মেইন  এন্ট্রান্সে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সদ্য আমদানিকৃত  আত্মারা;  ভেতরে এক এক করে হাঁক দিয়ে ডাকা হয় তাদের, “ অমুক জায়গার তমুক বাবুর আত্মা হাজির হো...। গুটি গুটি ডাকপ্রাপ্ত আত্মা হাজির হয় বিচার ক্ষেত্রে যেখানে চিত্রগুপ্ত মশাই তার চ্যালা চামুন্ডাদের সাথে বসে জাবদা খাতা ঘেঁটে সে আত্মার যাবতীয় পাপ-পুণ্যের হিসেবপত্তর বের করে যমরাজের সামনে পেশ করেন যিনি সেসব মূল্যায়ন করে সে আত্মাকৃত পাপের পরিমাণ অনুযায়ী  তাকে কোন নরকে পাঠানো হবে তার ডিসিশন নেন। যমলোকে আত্মাদের শাস্তি দেবার জন্য, বা তাদের শোধনের জন্য রৌরব, কুম্ভীপাক, কৃমিভোজন, বজ্রকন্ট ইত্যাদি আঠাশ রকমের নরকের ব্যবস্থা আছে যেখানে যমদূতেরা মনের সুখে তাদের টর্চার করে আত্মাদের সমস্ত সুখ শুষে নিয়ে থাকেন। কিন্তু যে সকল আত্মাদের এগেইন্সটে চিত্রগুপ্ত মশাই কোনরকম পাপাচারের কেস দিতে পারেন না তাদের পুণ্যাত্মা ডিক্লেয়ার করে বিষ্ণুলোকে চালান করে দেওয়া হয়।

 

তো ছেলেবেলা থেকেই এই থিওরি শুনে শুনে বড় হয়েছি।কেন জানিনা আমার মনে এক বদ্ধমূল ধারণা জন্মে গিয়েছিল যে আমি আর যাই হই না কেন পুন্যাত্মা কোনও অ্যাঙ্গেলেই নই এবং মৃত্যুর পর আমার ওই আঠাশ রকমের মধ্যে থেকে যে কোন এক রকমের নরকপ্রাপ্তি অবধারিত- এ নিয়তি কোন ব্যাটাই খণ্ডাতে পারিবেক লাই। আমার কনসেপ্ট আরও স্ট্রেনদেন করেছিলেন আমার গিন্নী- বিবাহিত জীবনে যখনই কোনও গোলমাল করেছি (আর এমনটা আকছার হয়েছে) শুনতে হয়েছে, ‘পাপ, পাপ, ঘোর পাপ। এমনটা কোরো না গো, সহ্য হবে না। এবং এর সাথে গিন্নি আমার দিকে এমন একখানা লুক দিয়েছেন দেখে মনে হয়েছে আমার চাইতে পাপী কোনও ব্যক্তি এ জগতে হায় আর থাকিতেই পারে না।

 

তা এধরনের চিন্তাভাবনা নিয়েই ছোট থেকে বড় এবং ধীরে ধীরে বুড়ো হওয়া গেল এবং একদিন দুপুরে খেতে খেতে বুক ধড়ফড় করা শুরু করল। শ্বাস নিতে পারছিনা, বাঁধানো দাঁতজোড়ার একখানা খুলে টপ্‌ করে খাবার পাতে খুলে পড়ল এবং পাশের কোন বাড়িতে গান বাজা শুরু করল-আপনা টাইম আয়েগা। সব দেখে শুনে বুঝলাম আমারও টাইম এসে পড়েছে। তার খানিক পরেই বাড়ির সব লোককে কাঁদিয়ে, খানিক এঁটো খাবার গালে মাখিয়ে, এক পাটি দাঁত গালে ও এক পাটি হাতে নিয়ে টপ্‌ করে মরে গেলাম।

 

মানুষ মরার পর কি হয় তা নিয়ে নানা জ্ঞানীজনে নানান থিওরি দিয়েছেন। কেউ বলেছেন মানুষ মরবার পর কোনও এক ভূত তার হয়ে ভূতগিরি করে; কেউ বলেছেন মানুষ মরার পর সে কিছুদিন ভূত হয়ে ঘুরে বেড়ায় আর মাঝে মাঝে রিফ্রেশমেন্ট এর জন্য স্বর্গ ও নরকের যাতায়াত করে; আর জেনারেল যে যমরাজের কনসেপ্টটা তা তো লেখার শুরুতেই দিয়েছি।

 

তা যা-ই হোক, মরবার পর আমি (বা আমার আত্মা) অপেক্ষা করতে লাগলাম যে কখন সেই পাকানো মুছড়, কাঁটানো মুষল ওয়ালা যমদূতেরা আমায় নিতে আসবেন। কিন্তু সে সব কিছুই হলো না বরং দেখলাম ড্রোন এর মত দেখতে কি যেন একটা এসে আমার মাথার ওপর চক্কর দিতে লাগল- ভাবলাম পাশের বাড়ির কোনও খোকার খেলনা হবে বুঝি। কিন্তু ওমা, সে ড্রোনখানা এসে আমার উপর কি একটা আলো ফেলল আর ওমনি আমি হড়াস করে তার ভেতর সেঁদিয়ে গেলাম। তার খানিকক্ষণ পর পিঁ করে একখানা শব্দ শুনিয়ে সেটা আবার আমায় কোথায় যেন নামিয়ে দিয়ে সটান উধাও। চারিদিকে তাকিয়ে দেখি তাজ্জব ব্যাপার, আমি তো কোনও যমালয়ে আসিনি! কোথায় যমরাজ, কোথায় চিত্রগুপ্ত, আর কোথায়ই বা তার জাবদা খাতা? এ তো দেখি হেব্বি টেক-স্যাভি জায়গা- চারিদিকে কি সব যন্তরপাতি লাগানো, মৃদুমন্দ আলো জ্বলছে, বিভিন্ন পোর্টালের মত তৈরি করা যেখানে বেশ কিছু লোক (নাকি আমার মত আত্মা) খুটখাট করছে।একদিকে গোল-গোল কি সব যেন রাখা যাতে অনেকে বসে আছে, একটায় গিয়ে বসলাম- দিব্যি বসা গেল। খানিকক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরঘুর করে একদিকে দেখি একখানা দরজা- হ্যাঁ পেয়েছি, এই তো দরজার পাশে একজন বিশালাকার গেটম্যান দাঁড়িয়ে আছেন, হ্যাঁ  তার গোঁপখানাও বেশ সরেস; যদিও প্রথাগত যমদূত মার্কা চেহারা নয় তবুও তাকে দেখলে কেন জানিনা তাদের কথাই মনে পড়ে যায়। কাছে গিয়ে শুধালাম, ‘দাদা এবার?’

 

কাঠখোট্টা জবাব আসলো, ‘অপেক্ষা করুন, ডাক আসবে।

 

আর কি, ব্যাপার স্যাপার যখন কিছুই বুঝতে পারছি না তখন র‍্যাপার মুড়ি দিয়ে বসে থাকাই শ্রেয় বলে মনে করলাম। ঠিক কতক্ষণ বসেছি বলতে পারব না, একটু বোধহয় ঢুলুনি মতও এসে গিয়েছিল, হঠাৎ শুনি কোথায় যেন আমার নাম ডাকা হচ্ছে, ‘পরাণ রায়, ভেতরের দেখা করুন।

 

আবার গিয়ে সেই গেটম্যানের কাছে দাঁড়ালাম, ‘দাদা এবার? আমিই পরান রায়।

 

গেটম্যান দরজার পাশে একটা চৌকো মতো জায়গায় আঙ্গুল দিয়ে কি একটা করল, দরজা খুলে গেল। এবার সে চোখ দিয়ে ইশারা করে বুঝিয়ে দিল যে আমায় ভেতরে যেতে হবে। গুটি গুটি পায়ে ভেতরে গিয়ে দেখি একটা মনিটর যাতে একটি মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। সে আমায় বললে, ‘নমস্কার, যমলোক এ আপনাকে স্বাগত জানাই। দয়া করে আপনার বায়ো-ডেটা টি ভরে দিন আর আপনার কোনও প্রশ্ন থাকলে জিজ্ঞাসা করুন।

 

নজর করে দেখি সামনে হড়াস্‌ করে একটা তাকের মত বেরিয়ে এলো এবং তার মধ্যে বোর্ডের মত কি যেন রাখা। সেটা হাতে নিয়ে বললাম, ‘এ তোমাদের কেমন যমলোক মা জননী? আমার জানা কোন ইনফরমেশন এর সাথেই যে কিছু মিলছে না। এ দেখি বড়ই সুন্দর জায়গা।

 

উত্তর এলো, ‘ক্ষমা করবেন, আপনার করা এই প্রশ্নটি আমার ডেটাবেস-এ নেই।

 

বললাম, ‘ডেটাবেস? তুমি ঠিক কী বলো তো?’

 

আমি য-ক-১০১, আমি একটি প্রোগ্রাম। আমি যমলোকে আগত আত্মাদের স্বাগত জানিয়ে থাকি।

 

প্রোগ্রাম!জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তবে আমরা মর্তলোকে যেমন জানি যমলোক কি তেমন নয়?’

 

ক্ষমা করবেন, আপনার করা এই প্রশ্নটি আমার ডেটাবেস-এ নেই।

 

ধুত্তোর, মর্তলোক হোক বা যমলোক, প্রোগ্রামদের কি এই একই ধারা? দু একটি প্রশ্ন বাদে কিছুই তাদের ডেটাবেসে থাকেনা। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তা তোমার এ বায়োডাটা কিভাবে ভরব? কলম তো দিলে না।

 

ওতে একটি লাল বোতাম আছে, টিপলে পরে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করবে। উত্তর দিন, হয়ে যাবে। কিছু লিখতে হবে না।

 

অতএব একটু পাশে সরে গিয়ে বোর্ডটার এক কোণে থাকা লাল বোতামটা চেপে দিলাম। যন্ত্র বললে, ‘ওম্ সূর্যপুত্রায় বিদ্মহে, মহাকালায় ধীমহি, তন্নো যমঃ প্রচোদয়াৎযমলোকের ডেটাবেস এন্ট্রি সিস্টেমে নবাগত আত্মাকে স্বাগত জানাই...

 

রমণে? বুঝিবে শমনে


1 টি মন্তব্য: