শুক্রবার, ১১ জুন, ২০২১

রমণে? বুঝিবে শমনে ২

একটি আত্মার আত্মকথা। আপনি যদি পূর্ববর্তী ভাগটা না পড়ে থাকেন এখনও তবে এক্ষনি আগে সেটা পড়ে নিন এখানে ক্লিক করে - 

রমণে? বুঝিবে শমনে (প্রথম ভাগ)


একটু পাশে সরে গিয়ে বোর্ডটার এক কোণে থাকা লাল বোতামটা চেপে দিলাম। যন্ত্র বললে, ‘ওম্ সূর্যপুত্রায় বিদ্মহে, মহাকালায় ধীমহি, তন্নো যমঃ প্রচোদয়াৎযমলোকের ডেটাবেস এন্ট্রি সিস্টেমে নবাগত আত্মাকে স্বাগত জানাই। আপনাকে এখন কিছু প্রশ্ন করা হবে, আপনি দয়া করে মুখে তার উত্তর উচ্চারণ করবেন। ধন্যবাদ।

 

কী আর করি, যন্তর যা বলবে তা-ই করতে হবে! তা এর পর যন্ত্র বেশ কিছু প্রশ্ন করল ও আমি তার উত্তর দিলাম, তার বিবরণ লিপিবদ্ধ করে এ লেখাকে আর দীর্ঘায়িত করতে চাই না। যাই হোক, সে পালা সাঙ্গ হবার পর যন্ত্রটি যথাস্থানে রেখে সামনের দিকে এগোলাম। খানিক দূরে গিয়ে দেখি প্যাসেজ এর মত এক জায়গা যেখানে সারি সারি সেই গোল গোল বসার জিনিসগুলি রাখা যাতে অনেকে বসে আছে। ঢোকামাত্র কোণায় দাঁড়ানো এক গুম্ফধারী বলে উঠলেন, ‘যান গিয়ে ওখানে বসুন, সময় হলে বিচারসভায় ডাক পড়বে।

 

বসলাম, ভাবলাম, ‘যাক এতক্ষণে তবে আমাদের চেনা যমলোকের ছবি দেখতে পাবো। এতক্ষণ যা সব দেখলাম মনে তো হচ্ছিল যে যমলোকে না, যেন কোনও  প্রাইভেট নার্সিংহোমে এসেছি।যাই হোক, বসে রইলাম; কতক্ষণ বসেছি জানিনা, দু-একবার ঢুলুনিও এসে গিয়েছিল বোধহয়- যমলোকে সময়ের হিসাব কি মর্তলোকের সাথে মেলে? জানিনা। হয়তো এদ্দিনে পৃথিবীতে কত কি বদলে গিয়েছে, হয়তো এদ্দিনে বাড়িতে আমার ফটোয় ঝোলা মালাও শুকিয়ে গিয়েছে, হয়তো এখন গিন্নি পান খাওয়া ধরেছেন- পান চিবোতে চিবোতে পাশের বাড়ির মল্লিকগিন্নির সাথে বরকে কিভাবে বাগে রাখতে হয় সে বিষয়ে পরামর্শরূপী আলোচনা জুড়ে দিয়েছেন। এমনই নানারকম চিন্তাভাবনা মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করছিল হঠাৎ চমক ভাঙল নিজের নামখানা শুনে-পরাণ যায় ভেতরে আসুন।

 

গুটি গুটি পায়ে দরজার দিকে এগোলাম। দুরু দুরু বক্ষ, ভয়ে জড়োসড়ো মন- এইবারে ধর্মরাজের সামনে গিয়ে পড়বো; জীবনে কত পাপ না জানি করেছি, চিত্রগুপ্তের আস্ত একটা জাবদা খাতা হয়ত আমার পাপের বিবরণ লিখতে লিখতেই ভরে গিয়েছে, হয়তো এক নরকে কুলোবে না, আমায় হয়ত ইন্সটলমেন্টে তিন চার রকম নরকে পাঠানো হবে, এসব ভাবতে ভাবতে দরজা ঠেলে ঢুকলাম। কিন্তু হা ঈশ্বর, এ কি দৃশ্য হেরিনু চক্ষে! ভেতরে যা আশা করেছিলাম তার কিছুই পেলাম না- না আছে সিংহাসনে বসে বসে গোঁপে তা দিতে থাকা যমরাজ, না জাবদা খাতার পাহাড়ের মাঝে চিত্রগুপ্ত। ছিমছাম এক ঘরে একটি টেবিলে কম্পিউটার চাপিয়ে তার সামনে সুন্দরী এক ললনা বসে আছেন; ঘরের এক দিকে একটি বন্ধ দরজা। ঘরে ঢোকামাত্র আমায় তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘শ্রী পরাণ রায়, আপনি কি জীবিতাবস্থায় বিবাহিত ছিলেন?’

 

হ্যাঁ’, আমি বললাম।

 

তিনি খটর খটর করে তার কম্পিউটারে কিছু টাইপ করে নিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, এই পাশের দরজা দিয়ে ভেতরে চলে যান, চিত্রগুপ্ত মহারাজ আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।

 

দরজা ঠেলে পাশের ঘরে গিয়ে দেখি এক বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবিল এ কম্পিউটার নিয়েবিশাল গুম্ফ শীর্ণকায়এক ব্যক্তি বসে আছেন; বুঝলাম ইনিই শ্রী চিত্রগুপ্ত মহাশয় এবং ওমনি এক পেন্নাম ঠুকে দিলাম। সামনে কিছু চেয়ার রাখা ছিল, উনি আমায় ইশারায় বসতে বললেন, বসলাম। কিছুক্ষণ চিত্রগুপ্ত মশাই তার কম্পিউটার স্ক্রিনে গভীর মনোযোগের সাথে কিছু দেখলেন, তারপর বললেন, ‘পরাণ যায়, আপনার জীবিত কালে বেশ কিছু পাপের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে... কিন্তু আপনি দেখছি বিবাহিত ছিলেন। যা-ই হোউক, আপনার ডেটাবেস আমি ধর্মরাজের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি, তিনিই আপনার বিচার করবেন। তবে...খুব সম্ভবত আপনি সুখলোকে যাবেন। আপনার চেয়ারে একটি সবুজ বোতাম আছে, সেটা টিপলেই আপনি ধর্মরাজের কাছে চলে যাবেন। কোনও প্রশ্ন?’

 

ভাবলাম এই সুযোগ, ব্যাপারটা কি হচ্ছে বুঝে নেওয়া যাক। বললাম, ‘স্যার, ইয়ে...মানে এটা কি সত্যিই যমালয়?’

 

কেন, আপনার এমনটা কেন মনে হচ্ছে?’

 

না, মানে ছেলেবেলা থেকে যমালয় সম্পর্কে যা যা শুনে এসেছি তার কিছুই দেখি মিলছে না। কম্পিউটার, প্রোগ্রাম, ডেটাবে...এসব কিছুই এখানে আছে বলে শুনিনি; যমদূত, বিষ্ণুদূত, আপনার জাবদা খাতা কিছুই দেখছি না যে!

 

আরে মশাই, পৃথিবী উন্নত হচ্ছে, যমালয় হবে না? নিশ্চিন্ত থাকুন, এটা যথার্থই যমালয়, আমিই চিত্রগুপ্ত। নিন, বোতামটা চেপে দিন।

 

বোতামে চাপ দিলাম, চারিদিকটা ঝাপসা মত হয়ে গেল, তারপর আবার সবকিছু স্পষ্ট হয়ে গেল। দেখি, সামনে এক বিশালাকায় ব্যক্তি এক হাতে একখানা ট্যাব নিয়ে তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে বসে বসে গড়গড়া টানছেন। বুঝলাম ইনিই ধর্মরাজ, টপ করে একটা পেন্নাম ঠুকে ফেললাম। ওমনি চারিদিকে আওয়াজ উঠল- ওম্‌ সূর্যপুত্রায় বিদ্মহে, মহাকালায় ধীমহি, তন্নো যমঃ প্রচোদয়াৎ।চারিদিকে সুন্দর একটা গন্ধ পেলাম। যমরাজ আমার দিকে আশীর্বাদের মুদ্রা করলেন, চোখ তার হাতে ধরা ট্যাব এ। বললেন, ‘নাহ্‌, চিত্রগুপ্তকে নিয়ে আর পারিনা। কতবার বলেছি যে বিবাহিত লোক দেখলেই কোনও স্পেশাল কেস ছাড়া আমার কাছে পাঠাবার দরকার নেই, সোজা সুখলোকে পাঠিয়ে দেবে! না হে, তোমায় কিছু বলবার নেই, তুমি সুখলোকে যাও।

 

যমরাজের কথা শেষ হওয়ামাত্র দেখি আবার সব ঝাপসা, তারপরই দেখি আমি চিত্রগুপ্তের সেক্রেটারিয়েট এর সামনে বসে আছি। চিত্রগুপ্ত বললেন, ‘দেখেছ, বলেছিলাম না সুখলোক! আরে বাবা, আমি কি আর পাঠাতে পারি, একটা প্রোটোকল আছে না!

 

বললাম, ‘স্যার। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। এই সুখলোকটা কি? আর এদ্দিন যে শুনে এসেছি আঠাশ রকমের নরকযন্ত্রণা- সেসব নেই?’

 

আরে বাপু আছে আছে, সবই আছে।চিত্রগুপ্ত বললেন, ‘কিন্তু তুমি হলে গিয়ে বিবাহিত, ওসব যন্ত্রণা টন্ত্রনা তুমি অলরেডি ভোগ করেই এসেছ। তাই বিবাহিত পুরুষ, যারা পূর্ণ বৈবাহিক জীবন ভোগ করে আসে, এখানে তাদের আর নরকে পাঠানো হয়না- নতুন করে আর কি যন্ত্রণা দেব? তাই তাদের জন্য স্বর্গের অনুরূপ এক স্থান আছে- সুখলোক, যেখানে শমনের পর সুখ ভোগ করতে পাঠানো হয়। বুঝলে?’

 

বুঝলাম, এতদিন হাড়ে হাড়ে বুঝেছি, এখন বেশ বুঝতে পারছি।

 

চিত্রগুপ্ত আবার বললেন, ‘আমার পেছনে দুটো দরজা আছে। যাও বাঁদিকের দরজা দিয়ে সুখলোকে গিয়ে ফুর্তি করোগে। নেক্সট!

 

এতক্ষণে দেখি চিত্রগুপ্তের পেছনে দুটো দরজা আছে- ডান দিকেরটার ওপরে লেখানরকলোকআর বাঁ দিকেরটার উপরে লেখাসুখলোক (শুধুমাত্র বিবাহিত পুরুষদের জন্য)। গুটি গুটি পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেলাম অবশেষে সুখ পাবার জন্য। 


(সমাপ্ত)

রমণে? বুঝিবে শমনে 2

1 টি মন্তব্য: