মঙ্গলবার, ১৩ জুলাই, ২০২১

আমার জন্য গুপী গাইন বাঘা বাইন

আমার আজকের লেখার বিষয় নিয়ে কতজনে কতবার কতরকমভাবে যে অলরেডি লিখে ফেলেছেন তা গুণে শেষ করতে গেলে আবার লোক রাখবার দরকার হবে। বিষয়টা আশা করি এ লেখার টাইটেল দেখে এতক্ষণে ধরে ফেলতে দেরি করেননি। আজ্ঞে হ্যাঁ মশাই, আজ আমি সর্ববরেণ্য সত্যজিৎ রায় মহাশয়ের এক অসামান্য কীর্তি গুপী গাইন বাঘা বাইন সিনেমাটি নিয়ে কথা বলার ইচ্ছা প্রকাশ করছি। যখন আমি ছোট ছিলাম আমার এক শিক্ষক মহাশয় কথায় কথায় বলেছিলেন যে গুপী গাইন বাঘা বাইন ফিল্ম সিরিজটি তার অত্যন্ত প্রিয়। আমি তখন তাকে বলেছিলুম, “স্যার, এ তো ছোটদের সিনেমা। আপনি ছোটদের সিনেমাও দেখেন?” সে-বয়সে আমার এটা জেনে বেশ আমোদ হয়েছিল যে আমার শিক্ষক মহাশয়ের মত একজন বয়স্ক লোক গুপী গাইন বাঘা বাইন এর মত ছোটদের জন্য তৈরি সিনেমা দেখেন।

 

সেদিন তিনি আমায় বলেছিলেন, “গুপী গাইন বাঘা বাইন যখন ছোটরা দেখে তখন তা ছোটদের সিনেমা, কিন্তু বড়রা দেখলেই তা বড়দের সিনেমা হয়ে যায়।আমি সেদিন তার কথার মানে বুঝিনি, জিজ্ঞাসা করেছিলুম যে এর মানে কি। তখন তিনি আমায় বলেছিলেন, “বড় হলে সিনেমাটা দেখো তাহলে আমার কথা মানে বুঝতে পারবে।

 

আমার জন্য গুপী গাইন বাঘা বাইন

কেন জানিনা তার কথাখানা আমি ভুলিনিহয়তো সত্যজিৎ রায় আমার প্রিয় লেখকদের একজন তাই। কিন্তু তার কথাটা যে কতদূর সত্যি তা আমি আজ এ বয়সে এসে উপলব্ধি করি। ছোট থেকে আমি যে গুপী গাইন বাঘা বাইন সিরিজের সিনেমাগুলো দেখেছি আমার নিজেরও মনে নেই, এবং প্রত্যেকবারই সিনেমাটি আমার কাছে এক নতুন রূপে নিজেকে মেলে ধরেছে। এই যেমন কাল বিকেলে কোনও কাজ ছিলনা হাতে, ভাবলুম কি করি, যথারীতি হাত চলে গেল মোবাইল ফোন এর দিকে। ইউটিউব খুলে কেন জানিনা গুপী গাইন বাঘা বাইন দেখা শুরু করলুম এবং শেষ পর্যন্ত তাতে আটকে রইলুম। তারপর থেকেই আমার হাত সুড়সুড় করছে এ নিয়ে কিছু লেখার জন্য।

 

তবে আমি সিনেমার পরিচালনা অথবা অভিনেতাদের অভিনয়ের সমালোচনা করবার চেষ্টা করবনা, আমার সে যোগ্যতাও নেই। কাল আমায় সিনেমাটির দু চারটে দৃশ্য বেজায় ভাবিয়েছে। আমি আজ এখানে তা নিয়েই কিছু কথা লিখব।

 

গুপির বাবার কথা মনে পড়ে? ছোট্ট ক্যারেক্টার- মাত্র দুটো সিনেতেই দেখা গিয়েছে, মুখও স্পষ্ট নয়, কিন্তু তা দিয়েই কি নির্মম সত্য জানিয়ে দেওয়া গেল! যখন বটতলার বাবুরা সহজ-সরল, বেসুরো গুপিকে নানারকম ঢপ দিয়ে রাজার কাছে পাঠাবার ফন্দি করলেন, গুপির বাবা তাকে কড়া ধমক দিলেন যে ফের এসব দেখলে তানপুরা ভেঙ্গে ফেলবেন। আমাদের সকলের ছেলেবেলার মতই গুপিও ভাবলে- বাবা আমার ভালো নয়, তিনি ক্রুর, বরং বটতলার সেই মধুরভাষী বাবুরাই তার আসল হিতাকাঙ্খী। কিন্তু যখন গুপিকে রাজা গাধার পিঠে চাপিয়ে বের করে দিচ্ছেন, বটতলার হুঁকোখোর বুড়োর দলের মুখে ফিচেল হাসি ভাসছে, একমাত্র গুপির বাবাকেই নীরবে চোখের জল ফেলতে দেখা গেল। এর মানে কি আর বুঝিয়ে দিতে হবে? মজাটা হচ্ছে এই কথাটা লিখতে ও পড়তে আমাদের যতটা সময় লাগছে, সত্যজিৎ রায় গুপির বাবাকে তার থেকেও কম সময় ধরে প্রজেক্ট করেছেন, মাত্র দুটো ছোট্ট সিন!

 

তারপর বাঘা যখন প্রথমবার নিজের নামখানা বলে। কেউ ভাবতে পেরেছে যেবাঘা বাইননামখানাকে এত সুন্দরভাবে প্রেজেন্ট করা যায়- বয়ে কাঠি, য়ে কাঠি, ঢোলে চাঁটি, বাঘা বাইন।

 

ভুতের নৃত্য- ছেলেবেলায় দেখে মজা পেতুম বেশ কিছু ভূত কি সুন্দর ল্যাগব্যাগ করতে-করতে নাচছে; এখন ভাবি সে যুগে, যখন অ্যানিমেশান, VFX তো কোন ছার, ঠিকমত কালার ফিল্মই চালু হয়নি, এ দৃশ্য সম্ভব হল কিভাবে? আমি ফিল্মমেকিং বিষয়ে ওস্তাদ নই, তাই এ রহস্য আমার আজও অজানা। তারপর ভুতের নাচ ও তার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। সেখানে ভুতের চারটে ক্লাস দেখানো হয়েছে, যথা- উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত, সাহেব এবং সুবিধেবাদীগন। উচ্চবিত্ত ভূতেরা মানুষের রাজা, উজিরদের মতই ক্লাসিক্যাল নাচ নাচছেন, মৃদঙ্গের তালে; নিম্নবিত্ত ভূতেরা সাধারণ চাষী ও কর্মীদের মত কাঞ্জিরার তালে তালে নিজেদের জীবনযাত্রা মেলে ধরেছেন; সাহেব ভূতেরা ঘটম্‌ এর তালে নিজেদের অ্যারিস্টোক্রেসি ও ভদ্রতার নিদর্শন দিচ্ছেন; এবং ভূতেদের সুবিধাবাদী ক্লাস (বাবু, শেঠ, জমিদার, প্রচারক ইত্যাদি) তারা মরসিং এর তালে তালে নিজেদের বিশাল বপু নাচাচ্ছেন। সর্বশেষে লাগে গৃহযুদ্ধ, যা অবশ্যম্ভাবী এবং তাতে সবাই মারা যায়। তবে এই যুদ্ধ কিন্তু এক-এক ক্লাস অনুযায়ী এক এক রকম- উচ্চবিত্তরা নাচতে নাচতে সিম্বলিক যুদ্ধ করেন, নিম্নবিত্তরা সত্তিকারের যুদ্ধ ও হাতাহাতি করেন, সাহেবেরা বাকযুদ্ধ করেন ও তাতেই মারা যান ও সর্বশেষে সুবিধাবাদী ক্লাসের বাবু ভূতেরা কিছুই করেন না, শুধুমাত্র অল্প ভুরিতে-ভুঁড়িতে ঠোকাঠুকি করতেই পড়ে যান।

 

তারপর আসি হাল্লার গুপ্তচরের ভূমিকায় চিন্ময় রায়ের কথায়। হাল্লার রাজা জাদুকর বরফির ওষুধের গুনে শুন্ডির দেবে পিন্ডি চট্‌কে, তাই মন্ত্রী তার গুপ্তচরকে পাঠায় শুন্ডিতে খবর নিতে। সে ফিরে এসে বলে শুন্ডিতে সৈন্য নেই, অস্ত্র নেই, হাতি, ঘোড়া, উট কিচ্ছু নেই। তাতে গুপ্তচরের খুশি হবার কথা; কিন্তু মন্ত্রী যখন বলেন, “শুন্ডিতে তবে আছে কি?” তার উত্তরেফসল আছে, আনন্দ আছে, খুশি আছেইত্যাদি বলতে বলতে গুপ্তচর কোথায় যেন হারিয়ে যায়। পেটের ক্ষিদে যে জয়ের আনন্দকেও ভুলিয়ে দেয়!

 

আর একটি জিনিসের উল্লেখ করে এ লেখা শেষ করব। সিনেমার শেষে যখন শুন্ডির রাজা গুপির সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে চান ও বাঘা তাতে রেগে যায়, হাল্লার রাজা জিজ্ঞাসা করেন, “রাজকন্যে কি কম পড়িয়াছে?” এ ডায়ালগটা তো অন্যভাবেও বলা যেত, কিন্তু এভাবে কেন বলা হলো তা আমি বুঝতে পারিনি। এ যেনআলু কি কম পড়িয়াছের মতন ব্যাপার; তবে কাজটি যখন স্বয়ং সত্যজিৎ রায় করেছেন নিশ্চয় এর কোন গুঢ় অর্থ আছে যা আমি বুঝতে পারিনি। পাঠককুলের কেউ যদি এ ব্যাপারে আমায় সহায়তা  করেন বাধিত হব। 

 


1 টি মন্তব্য: