বন্ধুমামার গল্পযান
(এক)
‘টুক-টাক, ঠুক-ঠাক’—আমাদের বন্ধুমামার ‘একান্ত আপন’ ঘরখানিতে গেলেই সর্বক্ষন এমন কিছু না কিছু শব্দ শোনা যাবেই যাবে। কারনটা আর কিছুই নয়—বন্ধুমামা একজন বৈজ্ঞানিক। তা সে তিনি কেমন বৈজ্ঞানিক, কী তার রিসার্চের
বিষয়, কী-কী তিনি আবিষ্কার করেছেন এসবের
কিছুই কিন্তু আমরা জানিনা। সেই ছেলেবেলা থেকে শুধু এটুকুই জেনে
এসেছি যে উনি বৈজ্ঞানিক। রোগা লিকলিকে চেহারায় সাঁড়াশির মত দুটো হাত, এক গাল কাঁচাপাকা
দাড়ি, কবি নজরুলের মত লম্বা-লম্বা চুল ও
চোখে গোল-গোল চশমা যার একখানা কাঁচ চিরকালই ভাঙা—এই বন্ধুমামা যে আমাদের ঠিক কেমন মামা তাও কিন্তু আমাদের অজানা। কারন আমরা বাড়ির ছোটরা, বাবা-মা, কাকু, ফুলজেঠু—সবারই উনি ‘বন্ধুমামা’। একমাত্র ঠাকুমা এবং ছোড়দাদুই তাকে
ডাকেন ‘বন্ধু’ বলে। এমনিতে কারও সাথে কথাবার্তা তেমন কন
না, তাই
তিনি রাগী কি নন তাও আমাদের অজানা। তবুও আমরা—মানে আমি, ঘোতন আর রুমি ওনাকে বেশ ভয় পেতুম, এড়িয়েও চলতুম। বন্ধুমামার ঘরে যাওয়াও আমাদের বারণ
ছিল, তাতে
তার কাজে নাকি ব্যাঘাত ঘটবে।
এ হেন বন্ধুমামার সাথে একদিন আকস্মিকভাবেই আমার বেশ
ভাব হয়ে গেল, আর আমি দেখলুম যে দেখতে যতই খ্যাপাটে হোন না কেন লোকটা আদপে তিনি একেবারেই
ভয়ংকর নন, মোটের ওপর দিয়ে বরং বেশ ভালই। সে গল্পই আজ বলব।
সেদিনটা ছিল বাড়ি শুদ্ধু সকল লোকের নেমন্তন্ন। আমার সেজপিসির ছেলে গোপালদাদার বিয়ে। দুদিন ধরে সবাই নানারকমের চিন্তাভাবনা
করে যাচ্ছি কী-কী খাব, কী-কী পড়ব এসব। আর আমাদের ছোটদের তো উৎসাহের অন্তই
নেই এ সকল ব্যাপারে। কিন্তু বিধি বাম, বিয়ের দিন দুপুর থেকেই আমার পেট খারাপ হয়ে
গেল—বার বার বাথরুমে যাচ্ছি আর আসছি। বাড়ির লোকেরা আর কী করবে, আমায় ওষুধপত্র দিয়ে,
কাঁচকলা সেদ্ধ আর ভাত খাইয়ে তারা সবাই মিলে বরযাত্রী চলে গেল। আর আমি রইলুম বন্ধুমামার দায়িত্বে—তিনি আবার কোথাও তেমন
যান টান না।
বিকেল অবধি মনমরা হয়ে বিছানায় পড়ে রইলুম, কিছুই ভাল লাগছিল
না। আর
ভাল লাগবেটাই বা কী করে,
বাড়ির লোকেরা, ঘোতন, রুমি
সবাই গিয়ে নাচাগানা করছে, চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় সব খাচ্ছে আর আমি বাড়িতে বসে কাঁচকলা সেদ্ধ
গিলে পড়ে আছি। খানিক্ষণ একখানা গল্পের বই নিয়ে গড়াগড়ি দেওয়া গেল। বন্ধুমামা ইতিমধ্যে দুবার এসে নজর
দিয়ে গিয়েছেন, যদিও মুখে বলেননি কিছুই। আর ভাল লাগছিল না, তাই ঘর থেকে বেরিয়ে
এদিক ওদিক ঘুরতে-ঘুরতে হঠাৎ চলে গেলুম বন্ধুমামার ঘরের সামনে। যদিও ওদিকে আমাদের যাওয়া বারণ তবুও
সেদিন কী খেয়াল হল সেদিকেই গেলুম। পাশাপাশি দুটো ঘর বন্ধুমামার—একটায় তিনি থাকেন আর
অন্যটায় তিনি না জানি কী সব যেন করেন। দুটো ঘরের মাঝামাঝি দরজা রয়েছে—যে ঘরে মামা থাকেন
সেখানে একটু উঁকি দিয়ে দেখি আমার দিকে পেছন ফিরে টেবিলে বসে বন্ধুমামা তিন চারটে বই
নিয়ে খানিক কী সব খুঁজে খুঁজে পড়ছেন আবার মাঝে মাঝে কি সব যেন লিখছেনও। ঘরে জিনিসপত্র বলতে ওই টেবিল চেয়ার
ছাড়া একটা প্রচণ্ড অগোছালো বিছানা, একটা আলমারি আর চারিদিকে শেলফে-শেলফে বোঝাই রাশি রাশি সব বই—কিছু বাংলা, কিছু ইংরিজি আবার কিছু কি সব অজানা ভাষার।
মামা বেশ মন দিয়ে লেখাপড়া করছেন আর আপাতত তার ওঠার কোনও
চান্সই নেই বুঝে আমি পাশের ঘরের দিকে এগোলুম—যথারীতি সেখান থেকে আজও কী সব ছ্যাঁক-ছ্যাঁক আওয়াজ ভেসে আসছে। দুরুদুরু বক্ষে পা টিপে টিপে গিয়ে
ঢুকলুম সে ঘরে—ওরেব্বাবা, সে কি বিশাল ঘর! কী
নেই সে ঘরে, দেওয়াল জোড়া বিশাল-বিশাল সব
আলমারি, তাতে দেখি কিম্ভুত কিমাকার সব যন্ত্রপাতি ঠাসা। আর শুধুই কি আর যন্ত্র—তার, ব্যাটারি, বই, রঙ বেরঙের নানারকম
তরল, কাঁচের নানারকম যন্ত্র, বোতলে-বোতলে আরকে ডোবানো সাপ, ব্যাঙ, গাছ গাছালি কী নেই সেখানে, মায় দেওয়ালের এক কোনায় একখানা
কঙ্কাল পর্যন্ত ঝুলতে দেখলুম। ঘরের মাঝে দুটো বড় বড় টেবিলেও বিস্তর
জিনিসপত্র। সব
দেখে আমার তো মাথা ঘোরবার জোগাড়। এদিক সেদিক ঘুরে ফিরে দেখছি হঠাৎ কানে
এল আবার সেই ছ্যাঁক-ছ্যাঁক আওয়াজখানা। শব্দটা লক্ষ্য করে এগিয়ে গিয়ে দেখি
সে এক তাজ্জব ব্যাপার—পাশাপাশি তিনটে ছোট ছোট গ্যাসের মত কী যেন জ্বলছে (পরে
জেনেছিলুম ওগুলোকেই ব্যুনসেন বার্নার বলে), তাতে তিনটে কাঁচের
বয়াম মত কী যেন চাপানো আর তার মধ্যে বেগুনি, নীল আর সবুজ তিনটে
তরল ফুঁটছে—যত ফুঁটছে তত ধোঁয়া বেরোচ্ছে। সেই ধোঁয়া আবার নল দিয়ে গিয়ে বুদবুদ
হয়ে বেরোচ্ছে আরেকখানা বয়ামে রাখা তরলে। সেই তরল গিয়ে ফোঁটা-ফোঁটা করে একটা নল
এর মাধ্যমে গিয়ে পড়ছে এক পাত্রে যাতে রাখা রয়েছে একখানা অদ্ভুতদর্শন গাছ। সেখানে যে তরল জমে রয়েছে তাতে আবার
দুটো তারও চোবানো রয়েছে যা থেকে-থেকেই সেখানে বিদ্যুতের তরঙ্গ খেলিয়ে দিচ্ছে আর তা থেকেই
সেই ছ্যাঁকছ্যাঁক শব্দটা হচ্ছে। সব দেখেশুনে আমি আরও অবাক হয়ে গেলুম। এদিক সেদিক আরেকটু ঘুরে দেখছি হঠাৎ নাকে কেমন একটা পোড়া-পোড়া গন্ধ এলো। গন্ধের উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখি—সর্বনাশ, সেই বিদ্যুতের স্ফুলিঙ্গ ছিটকে গিয়ে পড়েছে পাশে রাখা কিছু শুকনো কাপড়ের মত জিনিষে আর তাতে ধীরে-ধীরে আগুন লেগে যাচ্ছে। ‘এখন কী করা যায়? মামাকে ডাকব? তাহলেই তো ভাগ্যে জুটবে বকা আর ধমক’। হঠাৎ মাথায় এক বুদ্ধি খেলে গেল—কাপড়গুলোকে মাটিতে ফেলে পা দিয়ে চেপে আগুনটা নিভিয়ে দিলুম। কিন্তু আরও ফুলকি তো ছিটকে এসে আবার আগুন লাগাতে পারে। এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখি সেই তার দুটো গিয়ে লেগেছে এক যন্ত্রে, আর পাশেই দেয়ালের সুইচবোর্ডে গিয়েছে সেটার প্লাগ। কী খেয়াল হল গিয়ে সুইচটা অফ করে দিলুম—আর সাথে-সাথেই তারের ছ্যাঁকছ্যাঁকানিটা বন্ধ হয়ে গেল।
হাঁফ ছেড়ে যেই না পেছন ঘুরেছি, দেখি বন্ধুমামা কোমরে
হাত দিয়ে ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ব্যাস্, হয়ে গেল, আমি ভয়ে চোখে মুখে অন্ধকার দেখা শুরু করলুম, নিজের বুকের
ধুকপুক শব্দ যেন নিজেই শুনতে পাচ্ছি। চোখে দেখলুম মামা ঠোঁট নেড়ে আমায় কী
যেন বলছেন কিন্তু কানে কিছুই ঢুকল না। একটু ধাতস্ত হবার পর শুনলুম মামা বলছেন, ‘বুবুন, তুই এখানে কী করছিস?’
কিন্তু উত্তর দেব কি, আমার তো গলা শুকিয়ে কাঠ; আমি তখন পালাতে পারলে বাঁচি। হঠাৎ দেখি মামা আমার দিকে এগিয়ে আসছেন; হয়ে গেল, আজ পিটুনির হাত থেকে আমায় কে বাঁচায়?
‘কিরে বুবুন, তুই এখানে
কী করছিস বল?’ বলে মামা আমার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন।
‘না মামা, এমনি এসেছিলাম
দেখতে,
ভুল হয়ে গিয়েছে, আর-আর কোনদিনও
হবে না’। আমি
প্রায় কাঁদো-কাঁদো আওয়াজে বললুম।
‘না না, ঠিক আছে,
ভয় পাবার কিছুই নেই। আমি বেশ খানিক্ষন থেকেই দাঁড়িয়ে দেখছিলুম
তুই কী করিস। তুই
এতক্ষন যেভাবে আগুনটা নেভালি আর সুইচটা অফ্ করলি, দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি। তোর জায়গায় থাকলে আমিও ঠিক এমনটাই
করতুম। আচ্ছা, তুই কি জানিস আমি
এটা কী করছি? অথবা তুই কি আগেও লুকিয়ে আমায় এগুলো নিয়ে কাজ করতে
দেখেছিস?’
‘না মামা, কিন্তু আমার
খুব কৌতূহল হয়’, আমি জড়সড় হয়ে বললুম, আর
দেখে অবাক হয়ে গেলুম যে বন্ধুমামার হাতটা আমার কাঁধে চলে আসল এবং উনি আমায় ওনার থাকবার
ঘরে নিয়ে গেলেন।
‘শোন বুবুন, তুই আজ আমার
ল্যাবরেটরিতে একটা বড়সড় দুর্ঘটনা হবার থেকে বাঁচিয়েছিস, কিন্তু
তুই এসব জানলি কী করে?’
‘না মামা, মানে ওই যা মাথায়
এসেছে করে দিয়েছি। আমার আসলে খুব ভয় করছিল’। আমার ততক্ষনে ভয়টা একটু কমেছে।
‘হুম, তোর বিজ্ঞান সম্বন্ধে
জানতে ইচ্ছে করে?’
‘হ্যাঁ মামা, আমার বিজ্ঞান
খুব ভাল লাগে। আমি তো পড়ার বই বাদে শুধু গল্পের বই ও বিজ্ঞানের বই-ই পড়ি। একটা কথা জিজ্ঞাসা করব মামা?’
‘হ্যাঁ, তো কর না!
এত ভয় পাবার কী আছে? আমি কী বাঘ না ভাল্লুক যে
তোকে খেয়ে ফেলব?’
‘ওটা তুমি কী করছিলে মামা?’
‘ওটা বোঝাতে যে বেশ খানিকটা সময় লাগবে,
ওটা আরেকদিন বলব’খন। এখন কি কিছু খাবি? ওহ্, তোর তো আবার পেটে গণ্ডগোল; দাঁড়া, এক ডোজ ওষুধ দিচ্ছি। নে, হাঁ কর’।
সেদিন মামার দেওয়া এক ফোঁটা ঝাঁঝালো ওষুধেই আমার পেট
খারাপ একদম সেরে যায়। এ ঘটনার পর থেকে বন্ধুমামার প্রতি আমার ভয়টাও কমে যায় ও আমি
মাঝে-মাঝেই
ওনার ঘরে যাওয়া শুরু করি। না, সেদিনের সেই দুর্ঘটনা, বিদঘুটে যন্ত্র বা ওষুধ—কোনওটার কথাই আমি আর কাউকে বলিনি। কিন্তু পরে ধীরে-ধীরে বন্ধুমামা আমায়
সবই বলেছিলেন—যে তিনি এক নতুন প্রজাতির গাছ আবিষ্কার করবার চেষ্টা
চালাচ্ছেন। সেই
ওষুধটাও তারই আবিষ্কার;
এছাড়াও এমন অনেক কিছুই তিনি আবিষ্কার করেছেন। মাঝে-মাঝে তিনি বিদেশের
বিজ্ঞান কনফারেন্সগুলিতে গিয়ে তার দু-একখানা আবিষ্কারের নমুনা
অন্যান্য বৈজ্ঞানিকদের দেখিয়ে আসেন বটে, কিন্তু তার বেশিরভাগ
আবিষ্কারই থাকে লোকচক্ষুর অন্তরালে, তার একান্ত আপন গবেষণাগারে
বন্দী।
(চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন