যখন প্রশ্ন ওঠে যে ভূতেরা আসে কথা থেকে
তখন আমাদের জানা সাধারণ কনসেপ্ট হচ্ছে যে মানুষ মারা গেলে সে ভূত হয়- পবিত্র এবং তৃপ্ত আত্মারা
মুক্তিলাভ করে স্বর্গে যায়, অপবিত্র ও পাপীরা নরকে, কিন্তু অভিশপ্ত ও অতৃপ্ত আত্মারা ভূত হয়। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের
পাতায় পাতায় খোঁজ করলে দেখা যাবে সেখানে ব্যাপারখানা একেবারেই অন্যরকম। বিভিন্ন সাহিত্যিকেরা
তাদের লেখা নানান স্বাদের ভূতের গল্পগুলিতে ‘ভূত কি ভাবে তৈরী হয়’- এ ব্যাপারে নানা মত দিয়েছেন। আজ আমরা তারই কতকগুলি
নিয়ে আলোচনা করব।
বাংলা ভূতের গল্পের কথা উঠলেই যার নাম
সবার আগে উঠে আসে সেই ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় তার লেখা নানা গল্পে ভূতেদের উৎপত্তি
সম্পর্কে নানারকম থিয়োরি দিয়েছেন। যেমন তার গল্প ‘লুল্লু’ তে তিনি বলেছেন- ‘যেমন জল জমিয়া বরফ হয়, অন্ধকার জমিয়া তেমনি ভূত হয়’। উনি আরও বলেছেন যে- ‘লোকে বলে, অমুক মানুষ মরিয়া ভূত
হইয়াছে। কিন্তু সেটি সত্য নয়। মানুষ নিজে মরিয়া ভূত হয় না’। ত্রৈলোক্যনাথের কথায়
মানুষ মারা গেলে নাকি ভূতেরা কেউ গিয়ে তার ভূতগিরি করে। লক্ষ লক্ষ ভূত পৃথিবীতে
আছে। কেউ ভূতগিরি করবার কাজ পেয়েছে, কেউ ভূতগিরি করবার উমেদারি করছে আবার কেউ বেকার বসে আছে। ভূতেদের যিনি কর্তা, তিনিই সব ভূতেদের এই
কাজে নিযুক্ত করেন। ভূতকে তিনি বলেন, “যাও অমুক মানুষের সঙ্গে-সঙ্গে থাক, সে মরলে তার ভূত হয়ো, তার ভূতগিরি তোমায় দিলাম”। সেদিন থেকে সেই ভূত সে মানুষের সঙ্গে-সঙ্গে থাকে। মানুষটির শরীর খারাপ
হলে তার আর আনন্দের সীমা থাকে না; কারণ সে মরলেই তার ভূতগিরি করতে পারবে।
লেখক রাজশেখর বসু যাকে পাঠককুল ‘পরশুরাম’ নামে চেনেন তার গল্প
‘ভুশণ্ডীর মাঠে’ তে আরেকটি থিয়োরি দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন- ‘মানুষ মরিলে ভূত হয়
ইহা সকলেই শুনিয়াছেন। কিন্তু এই থিয়োরির সঙ্গে
স্বর্গ, নরক, পুনর্জন্ম খাপ খায় কীরূপে? প্রকৃত তথ্য এই।– নাস্তিকদের আত্মা নাই। তাহারা মরিলে অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন প্রভৃতি
গ্যাসে পরিণত হন। সাহেবদের মধ্যে যাহারা আস্তিক, তাহাদের আত্মা আছে বটে, কিন্তু পুনর্জন্ম নাই। তাহারা মৃত্যুর পর ভূত হইয়া প্রথমত একটি বড় ওয়েটিংরুমে জমায়েত হন। তথায় কল্পবাসের পর তাহাদের শেষ বিচার হয়। রায় বাহির হইলে কতগুলি ভূত অনন্ত স্বর্গে এবং অবশিষ্ট সকলে অনন্ত নরকে আশ্রয়লাভ
করেন। সাহেবরা জীবদ্দশায় যে স্বাধীনতা ভোগ করেন, ভূতাবস্থায় তাহা অনেকটা
কমিয়া যায়। বিলাতী প্রেতাত্মাগণ বিনা পাসে ওয়েটিংরুম ছাড়িতে পারে না। হিন্দুর জন্য অন্যরুপ বন্দোবস্ত, কারণ আমরা পুনর্জন্ম, স্বর্গ, নরক, কর্মফল, হৃষীকেশ, নির্বাণ, মুক্তি সবই মানি। হিন্দু মরিলে প্রথমে ভূত হয় এবং যত্র-তত্র স্বাধীনভাবে বাস করিতে পারে- আবশ্যক মত ইহলোকের সাথে
কারবারও করিতে পারে। এটা একটা মস্ত সুবিধা। কিন্তু এই অবস্থা বেশী দিন স্থায়ী নয়। কেহ কেহ দু-চার দিন পরেই পুনর্জন্ম লাভ করে, কেহ বা দশ-বিশ বৎসর পরে, কেহ বা দু-তিন শতাব্দী পরে। ভূতদের মাঝে-মাঝে চেঞ্জের জন্য স্বর্গে ও নরকে পাঠানো হয়। এটা তাদের স্বাস্থের পক্ষে ভাল, কারণ স্বর্গে খুব ফুর্তিতে থাকা যায় এবং
নরকে গেলে পাপ ক্ষয় হইয়া সূক্ষ্মশরীর বেশ হালকা ঝরঝরে হয়। তাছাড়া সেখানে অনেক ভাল ভাল লোকের সঙ্গে দেখা হইবার সুবিধা আছে। কিন্তু যাহাদের ভাগ্যক্রমে কাশীলাভ হয়, অথবা নেপালে পশুপতিনাথ বা রথের উপর বামনদর্শন
ঘটে, কিংবা যাহারা স্বকৃত পাপের বোঝা হৃষীকেশের উপর চাপাইয়া নিশ্চিন্ত হইতে পারেন, তাহাদের পুনর্জন্ম ন
বিদ্যতে- একেবারেই মুক্তি’।
এখানে কিন্তু লক্ষ করবার মত একটা ব্যাপার
আছে। দেখা যাচ্ছে যে লেখক ইংরেজদের ওপর স্বাভাবিকভাবেই বিশেষ খুব একটা প্রীত নন। কারণ তার সময়, অর্থাৎ স্বাধীনতার আগে
ভারতীয়দের প্রতি তাদের দূর্ব্যবহার ও অত্যাচার কারও অজানা নয়। তাই দেখা যাচ্ছে ভারতীয়
ভূতেরা মৃত্যুর পর ইংরেজ ভূতেদের থেকে অনেক বেশী স্বাধীনতা পাচ্ছেন (যা তারা জীবদ্দশায় পাননি), কিন্তু বিলাতী ভূতেদের
পাস ছাড়া কোথাও যেতেই দেওয়া হচ্ছে না।
তার লেখা উপন্যাস ‘কঙ্কাবতী’ তে ত্রৈলোক্যনাথ একখানা বেশ মজার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন যে ইংরেজী
পড়া বাবুরা যখন ভূতপ্রেত মানেন না তখন ভূতেদের খুবই অপমান করা হয়। গল্পে একটি ভূত তো ‘স্কল, স্কেলিটন এন্ড কোং’ নামে এক কোম্পানি খুলে
জায়গায় জায়গায় বক্তৃতা করে, বই ছাপিয়ে ও সংবাদপত্র বের করে এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবার কথাও
চিন্তা করে। এখানেও লেখকের ইংরেজী ও ইংরেজদের প্রতি বিরূপ মনোভাব দেখা যাচ্ছে, কারণ তৎকালীন সমাজে
মনে করা হত যে ইংরেজী পড়লে, বরফ খেলে (যা তৈরী করবার মেশীন বিলাতীরা আমদানি করেছিল) অথবা সমুদ্র পার করে
বিলেত ভ্রমন করলে জাত খোয়া যায়।
‘ডমরু চরিত’ উপন্যাসে ত্রৈলোক্যনাথ আবার অশ্বাণ্ড (ঘোড়ার ডিম!) বলে একটি লোক এর কথা
বলেছেন। তিনি লিখেছেন- ‘অল্পদিন হইল ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের নিকট গিয়া
যম আবেদন করিলেন, “বঙ্গদেশের বিটলে কপট স্বদেশ-ভক্তগণ শীঘ্রই প্রেতত্ব প্রাপ্ত হইবে। তাহাদের প্রেতকে আমার আলয়ে আমি স্থান দিতে পারিব না। তাহাদের কুহকে পরিলে আমি উৎসন্ন যাইব। ছেলেখেকো বক্তারাও শীঘ্রই প্রেত হইবে; তাহাদিগকেও আমি স্থান দিব না। আমার ছেলেগুলি তাহলে গোল্লায় যাইবে। স্বদেশী প্রবঞ্চকদিগের প্রেতকেও আমি স্থান দিতে পারিব না। আমার আলয়ে আসিয়া তাহারা হয়ত কোম্পানি খুলিয়া বসিবে। তখন যমনীকে হাতের খাড়ু বেচিয়া শেয়ার কিনিতে হইবে”। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর অনেক ভাবিয়া
চিন্তিয়া ইন্দ্রের ঘোড়া উচ্চৈঃশ্রবাঃ কে এক ডিম্ব প্রসব করিতে বলিলেন। বিশ্বসংসারের ওপারে ওই অণ্ড আছে। ইহাতে বিটলে স্বদেশভক্ত, ছেলেখেকো বক্তা ও স্বদেশী
প্রবঞ্চকগণের প্রেত বাস করে’।
ত্রৈলোক্যনাথ আরও লিখেছেন যে অশ্বাণ্ডের
দ্বারে দুই ভীষণ মূর্তি প্রহরী থাকে যারা এক কোডওয়ার্ড জাতীয় প্রশ্নোত্তরের পর্বে সফল
হলে তবেই কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেয়। প্রশ্নোত্তরের পর্বটি এইরকম-
প্রহরী, “হু কাম দার?” (Who comes there?)
প্রবেশক, “ফ্রেন্ড”। (Friend.)
প্রহরী, “পাস ফ্রেন্ড, অল ওয়েল”। (Pass friend, all
well.)
প্রশ্নোত্তরের পর্বটি আমাদের কাছে খুবই
সাধারণ মানের মনে হলেও মনে রাখতে হবে যে তৎকালীন সমাজ, যেখানে ইংরেজী প্রায় ব্রাত্য ছিল, তার কাছে এ ব্যাপারটি
কোডওয়ার্ডের চাইতে কম কিছু ছিল না।
অশ্বাণ্ডের ভেতরে আলোর বড়ই অভাব, কারণ আমাদের ব্রহ্মাণ্ডের
মত অশ্বাণ্ড পঞ্চতত্ব, যথা ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম দিয়ে গঠিত নয়; সম্পূর্ণ অন্ধকার দিয়ে নির্মিত যেখানে আলাদা আলাদা জায়গায় স্বদেশী
প্রবঞ্চক, ছেলেখেকো বক্তা ও বিটলে স্বদেশ ভক্তেরা থাকে।
বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ভূতের গল্প পড়লে
সাহিত্যের ভূতসমাজের বিষয়ে নানারকমের তথ্য আমরা পেয়ে থাকি। এই সকল ভূতেরা ভয়ংকর
তো একেবারেই নয়, বরং বেশ মজাদারই বটে (তাই বলে বাংলা গল্পে ভয় পাওয়ানো ভূত কি একেবারেই নেই? নিশ্চয়ই আছে, তবে তাদের কথা এখন নয়)। পড়তে পড়তে পাঠককুলের মনে কোথাও না কোথাও ইচ্ছে জন্মায় এসব ভূতের
দেখা পাবার; আর যদি একান্তই দেখা না পাওয়া যায় তবে নিজের জন্যে একখানা ভূত তৈরী করে নিতে ক্ষতিখানা
কোথায়? কি, ভূত আবার কেমন করে তৈরী করে? কেন, ত্রৈলোক্যনাথ তো বলেই দিয়েছেন- ‘অন্ধকার জমিয়া ভূত হয়। জল জমাইয়া বরফ করিবার কল আছে, অন্ধকার জমাইয়া ভূত করিবার কল কি সাহেবরা করিতে পারেন না? অন্ধকারের অভাব নাই। নিশাকালে অল্প-স্বল্প অন্ধকার থাকেই। তারপর মানুষের মনের ভিতরে যে কত অন্ধকার আছে, তাহার সীমা নাই, অন্ত নাই। কোদাল দিয়া কাটিয়া কাটিয়া ঝুড়ি পুরিয়া এই অন্ধকার কলে ফেলিলেই প্রচুর পরিমাণে ভূত
প্রস্তুত হইতে পারিবে। তাহা হইলে ভূত খুব শস্তা
হয়। একপয়সা, দুইপয়সা, বড়জোর চারিপয়সা করিয়া ভূতের সের হয়। শস্তা হইলে গরিব-দুঃখী সকলেই যার যেমন ক্ষমতা ভূত কিনিতে পারে’।
জিলেট জিলেকি সিলেমেল কিলেকিট কিলেকিশ।
Image Source:
- ত্রৈলোক্যনাথ রচনাবলী, সাহিত্যম। (Illustrator: Unknown)
- পরশুরাম গল্পসমগ্র, এম.সি.সরকার এন্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড। (Illustrator: অমিতাভ খান)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন