আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাদের তালগাছ, বেলগাছ ইত্যাদির নাম শুনলেই তার সাথে একজনের কথা মনে পড়ে যায়- অন্তত যারা ছেলেবেলায় (অথবা অন্য কোনও বেলায়,
ছেলেবেলা যে হতেই হবে তার কোনও মানে নেই) লীলা
মজুমদার এর ‘সব ভুতুড়ে’ পড়েছেন। ‘চেতলায়’ গল্পখানায় বটুর ছোট্-ঠাকুমার কথা মনে পড়ে? যিনি সাদা পাথরের রেকাবি করে খোয়া ক্ষীর, চিড়ের মোয়া
আর বড়-বড় মনাক্কা নিয়ে বাড়ির তালগাছের কোটরে রেখে ভক্তিভরে প্রণাম
করতেন প্রতিদিন? অথবা সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এর ‘সেই সব ভূত’, যেখানে ঠাকুমার বাড়ির পেছনে বাগানের
কোনের বেলগাছখানা খালি করে তার বাসিন্দা নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ায় ঠাকুমা ও মোনা ওঝার কি
মন খারাপই না হয়েছিল!
Click here to read this article in English. (This link will be active soon)
এই লেখাটি ইংরেজিতে পড়তে এখানে ক্লিক করুন। (এই লিংকটি শীঘ্রই এক্টিভেট করা হবে)
আজ্ঞে হ্যাঁ মশয়, আমি তাদের কথাই বলছি-
ব্রহ্মদৈত্য, অথবা ব্রহ্মদত্যি বা বেম্মদত্যি,
তাকে যে নামেই আপনি ডাকুন না কেন! আমাদের বটুর
ছোট্-ঠাকুমা ওনাদের একজনকেই তালগাছ-তলায়
ভোগ নিবেদন করতেন, আর ‘সেই সব ভূত’
এ ঠাকুমা ও মোনা ওঝারও বেলগাছের বেম্মদত্যি চলে যাওয়াতেই মন খারাপ করেছিল।
বেম্মদত্যি
বঙ্গসাহিত্যের ভূতসমাজে সর্বোচ্চ স্থানাধিকারী ব্রহ্মদৈত্যই
আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়। ব্রহ্মদৈত্য
নামেই তার কূল এর পরিচয় পাওয়া যায়- ব্রাহ্মণ ব্যাক্তিরা মৃত্যুর
পর ব্রহ্মদৈত্য হন। নানান
গল্পে তাদের নানা রূপের বিবরণ পাওয়া যায়, তবে খানিকটা জেনারেলাইজ
করলে (আর হ্যাঁ, খানিকটা আমার নিজের মস্তিস্কপ্রসুত
তো বটেই!) তা কিছুটা এরকম- বৃদ্ধ,
মাথায় চুল কম বা টাকওয়ালা, খালি গায়ে ধুতি ও গলায়
পৈতে, পায়ে খড়ম, হাতে ছড়ি থাকলেও থাকতে
পারে, হুঁকো খাবার অভ্যাস থাকতে পারে। সাধারণত তেনারা বেলগাছে থাকেন ও বিশেষ শাস্ত্রজ্ঞানী
হন। বেশিরভাগ
গল্পে ব্রহ্মদৈত্যদের উপকারী ভূত হিসেবেই চিত্রিত করা হয়ে থাকে; লোকের ক্ষতি করা- যথা ঘাড় মটকানো, ভয় দেখানো ইত্যাদি তাদের করতে দেখা যায় না, বরং কেউ বিপদে-আপদে পড়লে তেনারা তাদের উপকারই করে থাকেন। যেমন লীলা মজুমদার এর ‘চেতলায়’ গল্পে তালগাছ নিবাসী ব্রহ্মদৈত্য
বটু ও তার বন্ধুকে চিংড়িমাছ-ভাজা খাইয়েছিল ও ছোট্-ঠাকুমাকে তালগাছের গুঁড়ির ভেতর এক বাক্স দৌলতের হদিশ দিয়ে গিয়েছিল।
কচ্চিদ-কদাচিত এনারা প্রেমে-ট্রেমে পড়ে থাকেন বটে, যেমন পরশুরাম এর ‘ভুশণ্ডীর মাঠে’ গল্পের নায়ক শিবু ভট্টাচার্য মড়ার
পর ব্রহ্মদৈত্য হয়ে ভুশণ্ডীর মাঠের এক নেড়া বেলগাছে আস্তানা করবার পর এক পেত্নী,
এক শাঁকচুন্নি ও এক ডাকিনীর সাথে রোমান্সের চেষ্টা করে ও শেষে ডাকিনীকে
বিয়েও করে ফেলে। তবে
এমন ঘটনা খুবই বিরল ও আমাদের শিবুর বয়সখানাও তো ভাবতে হবে! সে যে খুবই কম বয়সে ব্রহ্মদৈত্য হয়েছিল, এমন বয়সে একাধটুক
রস তো মনে থেকে যেতেই পারে।
তবে এমন দু-চারটে এক্সেপ্শনাল এক্সাম্পল্ ছাড়া জেনারেলি ব্রহ্মদৈত্যদের মধ্যে
একটা বেশ প্রপিতামহসুলভ ব্যাপার লক্ষ্য করা যেতে পারে।
প্রেতেন্টারভিউ
[এই বিভাগে আপনারা একটি করে ইন্টারভিউ (অবশ্যই কাল্পনিক) পরবেন। আজকের ইন্টারভিউ করা হয়েছে বেলগাছের বেম্মদত্যির। যদিও সাধারণত ভূতেরা নাকি নাঁকি সুঁরে
কঁথা বঁলে থাঁকেঁন, কিন্তু টাইপিং এর সুবিধার্থে চন্দ্রবিন্দুগুলি
বাদ দেওয়া হল, দয়া করে কল্পনা করে নেবেন।]
ঋতম - ভূত হিসেবে আপনার
জীবন কেমন কাটছে?
ব্রহ্মদৈত্য - তা ত বাবা কাটতেছে ভালই, দিব্য গাছে-গাছে, ডালে-ডালে দুলছি-ঝুলছি, নোকজন দেকছি, আর কি চাই
গো!
ঋতম - আপনার মৃত্যুর আগের জীবন বেশি ভালো ছিল না এখন? আপনার কি মনে হয়?
ব্রহ্মদৈত্য – দুখানাই ভাল বাবা, কেউই কারোর চাইতে কম নয়। বেঁইচে থাকা জেবনের যেমন কিছু কিছু সুবিধে
ছেল জা এখন আর নেইকো। যেমন
আগে শ্বাস নেতে পারতুম, ভয় পেতে পারতুম, কিন্তু এখন আর কোনোটাই পারিনে। বুকের ভেতরখান কেম্নি জানি ফাঁকা-ফাঁকা। তারপর ওই ধর্ দশ্রথের বড় বেটার নামখানা- নিলে
পড়ে আগে কিছুই হত নি, এখন আর পারিনে। লোকে ভাইবে আম্রা ভয় পাই, কিন্তু ভয়-টয় নয় রে
বাপু- ওই নামখান্ মড়ার পর থেইকে আর উচ্চারণই
কইরতে পারিনে। আমি
বহুবার টেরাই কইরে দেকেছি, হয়নিকো, পারিনে।
ঋতম – আর এখন?
ব্রহ্মদৈত্য – এখন? এখন হাওয়ায় উইরতে পারি, পল্কে যেখ্নে খুশি যেইতে পারি, ইচ্ছে
কইরলেই গায়েব হয়ে যেইতে পারি, জাদু-টাদু
কইরতে পারি। আগে
এইগুনো কিছুই পারতুমনি। সুবিধে
কি কম রে বাপু?
ঋতম - আপনি যাদুও করতে পারে? কিরকম?
ব্রহ্মদৈত্য – ওরে ছোড়া, আমরা যেইখেনে জাদুও তো সেইখেনেই। এই যে দেকছো হুঁকোখানা টানছি, তার কলকে কি আর আমারে কিনতে হয়? ইচ্ছে করলুম আর এইসে
পড়ল! এই যে তোমাদের সব লিখিয়েরা আমাদের নিয়ে সব নানারকম কতা,
গপ্প সব লেখে সে কি আর তাদের নিজেদের লেখা? না। যখনই আমরা নিজেদের নিয়ে কিছু ব্যাপার-স্যাপার তোমাদের জানাতে ইচ্ছে করি, ওম্নি সেটারে কোনও গপ্পোরূপে তোমাদের লিখিয়েদের মাথায় দিই ঢুকিয়ে। এ জাদু নয় তো কি?
ঋতম – শেষ প্রশ্ন,
আপনি বা অন্যান্য ব্রহ্মদৈত্যেরা শুধুমাত্র বেলগাছেই বাসা বানান কেন?
ব্রহ্মদৈত্য – এ আবার একটা কতা হল? আমরা হলুম গিয়ে বামুন, পুন্যাত্মা। বেল
গাছের মত পবিত্তর গাছে আমরা থাকবনি তো কে থাইকবে? বেটা যখ, নাকি কারিয়া?শন হে ছোড়া, আমরা হলুম
গ্যে বামুন- সে মড়ার আগেও ছেলুম পরেও আছি, বুইঝলে?
ঋতম – না মানে ঠিক তা
নয়...।
ব্রহ্মদৈত্য – তা নয় তো কি হে? মেলা ফ্যাচ্ফ্যাচ্
কোরো নি তো বাপু, এবার বিদেয় হও। অনেক হয়েছে।
(ব্রহ্মদৈত্য মশাই অদৃশ্য নহয়ে যান।)
ইন্টারভিউটি শুনতে চাইলে এখান থেকে শুনতে পারবেন (চাইলে ডাউনলোড করে নিয়ে কাউকে শোনাতেও পারবেন)-
Image Illustrations:
- Coloured cartoons- Ritam Ghosal
- Black and white- Parashuram Golpo Somogro (Illustrator- Amitabh Khan)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন