সোমবার, ৪ মে, ২০২০

হাসি-ক্লাসি-ফিকে-শান্ ২


ক্লাসিফিকেশান্


গত লেখায় হাসির গুরুত্ব এবং হাসার যে কলা তা নিয়ে নানারকম পয়েন্ট আমি আলোচনা করেছি আজকের নিশানা নানারকমের হাসির প্রকারভেদ যদি আগের লেখাখানা আপনার এখন পড়া না হয়ে উঠে থাকে তবে নীচের লিঙ্কটিতে কুটুস্করে একখানা চাপ দিয়ে পড়ে নিতে পারেন এখনই

হাসি-ক্লাসি-ফিকে-শান্‌ (প্রথম ভাগ)


তা সে যাই হোক, নানারকমের হাসি থেকে জেনারেলাইজ করলে হাসি মোটামুটি নিম্ন প্রকারের হয়-

মুচ্কি হাসি


হাসি ক্লাসিফিকেশান্

মুচ্কি হাসি যে ঠিক কী তা আশা করি পাঠককুলকে বলে দেবার দরকার নেই, কারণ এটা পড়তে পড়তেই হয়ত আপনারা এখন মুচ্কি-মুচ্কি হাসছেন ডিক্শেনারিয়ান অর্থ যদি বলতে হয় তা হল- বদ্ধ ঠোঁটে সামান্য প্রদর্শিত মৃদু হাসি; অর্থাৎ কিনা মুচ্কি হাসতে গেলে ঠোঁট চেপে বন্ধ করে রাখতে হবে, দাঁত দেখানো যাবে না আর শব্দ তো নৈব নৈব চ সিম্পটম গেল এবারে আসি সিচুয়েশানে, মানে কখন-কখন কেমন-কেমন অবস্থায় মুচ্কি হাসি হাসতে হবে- প্রথমত, যেখানেই ভদ্রতার ব্যাপার থাকে, মুচকি হাসিই একমাত্র অপশান্ আপিসে বস্কিছু বলল, মুচ্কি হাসুন; পথে অপরিচিত কেউ কিছু বলল? মুচ্কি হাসুন; কোনও মিটিং সেরে গুডবাই করছেন? মুচ্কি হাসুন; কোনও ফ্যামিলির জায়গায় ইটিং এ গিয়েছেন? মুচ্কি হাসুন কখনও কিছু এড়িয়ে যেতে হলে মুচ্কি হাসি চাইই চাই, আর কোনও রিকোয়েস্ট এর সাথে মুচ্কি হাসি মাস্ট ভাই

মিষ্টি হাসি


হাসি ক্লাসিফিকেশান্

মিষ্টি হাসি হাসবার কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম আমি খুঁজে পাইনি, এ ধরনের হাসির কন্সেপ্টখানা পুরোপুরি সাইকোলজিকাল- যে হাসি কাউকে হাসতে দেখে আপনার মন খুশি হয়ে যাবে, প্রাণ ভরে যাবে ও তার পর মন ও প্রাণ আনন্দে আত্মহারা হয়ে একসাথে কথাকলি নৃত্য করতে করতে বার বার সে হাসি দেখতে চাইবে সেটাই মিষ্টি হাসি এ হাসি মুখ বন্ধ করে হাসা যেতে পারে, মুখ খুলে হাসা যেতে পারে, দাঁত লুকিয়ে হাসা যেতে পারে এমনকি দাঁত দেখিয়েও হাসা যেতে পারে তবে একটা ব্যাপার, জেনারেলি এ হাসির সুন্দরী নারী ও আদুরে শিশুরা বেশী হেসে থাকে; তবে পুরুষকূলের সাথে যে হাসির অ্যাসোসিয়েশান একেবারেই নেই আমি সে কথা বলছি নে সাধারনতঃ হাসি জোর করে হাসা যায় না, যখন হবার নিজে থেকেই ডিসপ্লে হয়ে থাকে, তবে আপনারা আয়নার সামনে একলা দাঁড়িয়ে চেষ্টা করে দেখতে পারেন; হবে না তা বলছিনে, তবে আমি পারিনা!

দুষ্টু হাসি

হাসি ক্লাসিফিকেশান্

এই দুষ্টু হাসি মিষ্টি হাসি দুইয়ের মধ্যেকার তফাত খুবই সূক্ষ্ম, যেন একে অপরের ভাই; কিন্তু এই দুই হাসির মধ্যেকার রিলেশানখানা অনেকটা ভাল্ টিউব লাগানো পাইপের মত- দুটোই একে অপরের সাথে জোড়া কিন্তু ভাল্ যেমন একদিক থেকে হাওয়া (বা জল) আরেকদিকে যেতে দেয় কিন্তু ফেরত আর আসতে দেয় না তেমনি দুষ্টু হাসি মিষ্টি হয়েই থাকে কিন্তু মিষ্টি হাসি যে সবসময় দুষ্টু হবেই তার কোনও মানে নেই, হতেও পারে নাও হতে পারেতবে মিষ্টি হাসির মতই দুষ্টু হাসিও একটি স্পন্টেনাস্হাসি- হওয়ার হলে নিজে থেকেই হবে, চেষ্টা করে বের করা খুব মুশকিল

কাষ্ঠহাসি



হাসি ক্লাসিফিকেশান্




এর আগে যে দুটি হাসির ব্যাপারে আলোচনা হল, যথা মিষ্টি হাসি দুষ্টু হাসি, দুটি নিজে থেকে না হলে কিছুতেই হাসা যায়না; কিন্তু এবারের হাসির প্রকারটি, মানে কাষ্ঠহাসি, আবার নিজে থেকে কিছুতেই হয়না, সব সময়ই জোর করে বের করতে হয় ডিক্শেনারিয়ান অর্থ যদি দেখতে হয় তা হল- মুখবিকৃতিসহকারে জোর করিয়া দন্তোদ্ঘাটন করা; সোজা বাংলায় বললে, আপনার হাসতে ইচ্ছে করছে না কিন্তু হাসতে আপনাকে হবেই এমন অবস্থায় যে হাসি বের হয় আর কি! কেন, মনে পড়েনা ছেলেবেলার সে সব সিচুয়েশান্‌, যখন ক্লাস টেস্টের জঘন্য নম্বরওয়ালা খাতাগুলি বাড়ি নিয়ে এসে ভাবতেন যে খাতা কিছুতেই বড়দের হাতে পড়তে দেওয়া যাবেনা ব্যাগে খাতাখানা লুকিয়ে রেখে জাস্ট ভাবছেন যে এটাকে কথায় হাপিস করা যায় ঠিক তখনই মা এসে ধরল, “কিরে, শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে এদিক-সেদিক কী খুঁজছিস? কী হয়েছে? আর আজ তোর ক্লাস টেস্টের নম্বর দেখানোর কথা ছিল না, কেমন হয়েছে?” এদিকে ব্যাগে খাতা, তাতে স্কেল পিঠে ভাঙবার মত নম্বর, বুক ঢিপ-ঢিপ, মুখ কাঁচুমাচু আর সামনে মা- একটা ট্যাঁ-ফোঁ হলেই সর্বনাশ! এমন কন্ডিশানে হাসি পাচ্ছেনা কিন্তু সব ম্যানেজ করবার জন্যে জোর করে যে হাসিখানা হাসতেন সেটাই কাষ্ঠহাসি

কষ্টহাসি



হাসি ক্লাসিফিকেশান্

নামখানি পড়েই আশা করি বুঝে ফেলেছেন এ হাসির অ্যাসোসিয়েশান একেবারে বুকের ভেতর থেকে উথলে ওঠা কষ্টের সাথে; যদিও হাসি, তবুও এর সাথে আনন্দের বা খুশির কোনওরকম কোনও সম্পর্ক ন বিদ্যতে- শুধু অ্যান্ড শুধুইমাত্র দুঃখপ্রচন্ড দুঃখ-অবসেস্ড অবস্থায় যদি কোনও কারণে কোনও বিষয়ের ওপর হতাশাগ্রস্থ, শ্লেষমিশ্রিত, অতিমৃদু কোনও হাসি বেরোয় সেটাই কষ্টহাসি মনে করুন খুব সম্প্রতি আপনার ব্রেকাপ হয়েছে, আপনি এখনও আপনার পুরোনো প্রেম ভুলতে পারেননি, দুঃখে-যন্ত্রণায় খাতা কলম নিয়ে বসলেইমনে মনে বড় ব্যাথা বেদনা, মনে মনে বড় জ্বালাজাতীয় সব বিরহের লাইন বেরুচ্ছে, ভাবছেন মদ ধরবেন কি ধরবেন না; এমন অবস্থায় আপনার কোনও এক বন্ধু দাঁত বের করে এসে হেসে আপনাকে জানাল যে সে ফের প্রেমে পরেছে (কত নম্বর সে নিজেই ভুলে গিয়েছে), আর এবারেরটা নাকি একেবারেফার্স্টক্লাস আপনি মনে মনে ভাবলেন, ‘ভাই আমি মরছি আমার জ্বালায়, আর তুমি তো সুখেই আছো’, আর ঠিক তার পরই সে তার মোবাইলখানা আপনাকে তা নতুন জিএফ এর এর পিক দেখালো এবং আপনি দেখলে যে সে আপনারই এক্স! ঠিক এমন অবস্থায় হতাশায়, যন্ত্রণায়, শ্লেষে আপনার ঠোঁট চিরে যে হাসি বেরুবে সেটাই কষ্টহাসি এ হাসির আরও রাশি রাশি উদাহরণ ও সিচুয়েশান্দেওয়া যায় কিন্তু অত কষ্ট আমার কলম বেচারির সহ্য হবে না, তাই ইতি টানছি

অট্টহাসি



হাসি ক্লাসিফিকেশান্

এ হাসি হচ্ছে সবচাইতে অরিজিনাল ও সবচাইতে বেশী আনন্দদায়ক হাসি পৃথিবীতে আর যাই থেকে থাক না কেন এমন কোনও সুস্থ ব্যাক্তি বোধহয় নেই যে কখনও অট্টহাসেনি, তাই অট্টহাসি যে কি ধরনের হাসি তা বিশ্লেষণ করে আমি আর সময় নষ্ট করছি নে তার চাইতে বরং কোন-কোন সিচুয়েশানে অট্টহাসি হাসা হয়ে থাকে তা নিয়ে কিঞ্চিত আলোচনা করা যাক

যাত্রাপালায় অট্টহাসির প্রচন্ডরকমকের ব্যাবহার হয়ে থাকে; যদিও এখনকার এই আল্ট্রামডার্ন যুগে শহরে যাত্রাপালা প্রায় দেখা যায়ই না বলা যায়, কিন্তু গাঁ-গঞ্জে যাত্রাপালা ব্যাপারটা এখনও ভালোরকমই জনপ্রিয় আমাদের কোচবিহারের অতিপ্রসিদ্ধ রাসমেলার সময়ও মদনমোহন মন্দির চত্তরে মেলা চলাকালীন বেশ কখানা যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে তো এই যাত্রাপালার সবচাইতে জনপ্রিয় হাসির প্রকারগুলির মধ্যে একখানা হল অট্টহাসি; স্পেশালি ভিলেনেরা এ হাসি প্রায়শই হেসে থাকেন এছাড়াও সিনেমার ভিলেনদের, মহালয়ার মহিষাসুরকে ও ছানাদের রূপকথার কার্টুনের রাক্ষসদেরও মাঝে-মধ্যেই অট্টহাসতে দেখা যায় তবে এটুকু পড়ে পাঠকেরা যেন ভেবে নেবেন না যে আমি বলতে চাইছি যে নেগেটিভ চরিত্রেরাই একমাত্তর অট্টহাসি হেসে থাকেন কেন, অল্পবয়সে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে বসে যখন কারও পেছনে লাগতেন তখন জোরে-জোরে, হো-হো করে হাসেননি বুঝি? সেটাও তো অট্টহাসির একটা প্রকার অট্টহাসির একটা মজা হচ্ছে যে এ হাসি প্রাণ ভরে হাসবার পর মনটা বেশ ভাল হয়ে যায়, মুডটা বেশ ফ্রেশ-ফ্রেশ লাগে; এজন্যই তো ডাক্তারবাবুরাও মাঝে-মধ্যে এ হাসি হাসতে বলে থাকেন লাফিং ক্লাবে লোকজনদের ভোরবেলায় দু হাত ওপরে করে হা-হা করে দিলখোলা হাসতে দেখেননি? সেও যে অট্টই এক হাসি

দেঁতো হাসি



হাসি ক্লাসিফিকেশান্

নামখানাতেই এ হাসির পরিচয় লুকিয়ে আছে- শব্দে হোক বা নিঃশব্দে, জোর করে হোক বা নিজে থেকে, মজায় হোক বা সাজায় (সাজা পেলে লোকে হাসে না ভাবছেন? কেন, ছুটির দিনে বাড়িতে সবাই ঘুম্যে পড়লে, হাতে কোনও কাজ না থাকলে, লোভ হলে চুপিচুপি রান্নাঘরে দুধের সর বা গুঁড়ো দুধ চুরি করে মুখে পুরবার মুহূর্তে কেউ যদি এসে ধরে ফেলে আপনি কি করবেন, কাঁদবেন?) তো জেভাবেই হাসুন না কেন, হাসিতে দন্ত প্রদর্শন মাস্ট হেঁ-হেঁ-হেঁ-হেঁ হাসি, ক্যাবলা হাসি, আদুরে হাসি (এটা ছানাদের ক্ষেত্রে বেশী প্রযোজ্য), খাদ্যচুরি করা হাসি (সিচুয়েশনাল্এক্সেমপ্লিফিকেশান্আগেই করেছি) নানারকমের হাসি এ কোটার আওতায় এসে থাকে ব্যাপারখানা খুবই জমে যায় যদি এ হাসি হাসবার সময় হাসনেওলা পান খেয়ে থাকেন ও তার পানের লালাসিক্ত লালচে দাঁতে পানের ছোপ হাসবার সময় দেখা যায়; অবিশ্যি জমে যায় বললুম ঠিকই, তবে সে জমা জমে অবশ্যই নেগেটিভ অ্যাসপেক্ট এ নারীকূলের কোনও রিপ্রেজেন্টেটিভকে যদি ইম্প্রেস্করিতে চান তবে কিন্তু পান খাওয়া দেঁতো হাসি নৈব নৈব চ

ঈর্ষাকাতর হাসি


(ডিস্ক্লেমার - যিনি লেখা পড়িতেছেন তিনি পাঠক না হইয়া যদি পাঠিকা হন এবং তার হস্তের কাছেপিঠে যদি রুটির বেলন, স্কেল, ডাঁশা, লাঠি ইত্যাদি থাকিয়া থাকে তবে দয়া করিয়া এই ভাগখানা পড়িবেন না আপনার মনে হইতেই পারে যে ইহা জেন্ডার ডিস্ক্রিমিনেশান্এর একটি পারফেক্ট উদাহরণ পাইয়া গেলেন, কিন্তু বিশ্বাস করুন, এই বয়সে লাঠিপেটা হইবার ডেঞ্জার হইতে সে বদনাম ভাল)


হাসি ক্লাসিফিকেশান্

ঈর্ষাকাতর হাসি এমন এক প্রকারের হাসি যার নির্দিষ্ট কোনও ফিজিকাল অ্যাপিয়ারেন্স নেই, অর্থাৎ ঠিক কিভাবে হাসলে যে সেটা এ হাসি হবে তা কেউ বলতে পারবে না মূলতঃ এ হাসিকে ক্যারেক্টারাইজ্করে অন্তরের জ্বালা, তাও আবার যে সে জ্বালা নয়- ঈর্ষা বা হিংসে তবে আটানব্বুই পারসেন্ট ক্ষেত্রে এ হাসি মহিলাদের কপিরাইট করা, পুরুষরা সাধারণতঃ আত্মভোলা টাইপের হন যারা আশেপাশের লোকেরা কি করল, কি বলল সেদিকে ফিরেও তাকান না; কিন্তু মহিলারা সর্বব্যাপী, সর্বদিকে ও সর্বব্যাপারে তাদের তীক্ষ্ণ নজর তাই আশেপাশে কি হচ্ছে যা তিনি করতে পারছেন না বা পাচ্ছেন না তা তার নখদর্পণে; এর ফল ঈর্ষা এবং ঈর্ষাকাতর হাসি (অবিশ্যি সবসময় নয়, মাঝেমধ্যে দাঁতখিঁচুনিও বটে!) লক্ষ্য করে দেখলে একটা ব্যাপার নজর করা যায়- অনেক সময়ই এ হাসি হাসবার সময় হাসিয়ের একটি ভ্রু উঠে যায় ও মুখ একদিকে বেঁকে যায়, তবে এমন যে হবেই তার কোনও মানে নেই

তা এ হাসি, সে হাসি করে মনে যতরকম হাসি এল তার প্রায় সবগুলোকেই কভার করার চেষ্টা করলুম, তাও যদি দু-চারখানি বাদ হয়ে যায় আশা করি পাঠককুল নিজগুনে আমায় মার্জনা করবেন




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন