শনিবার, ২৩ মে, ২০২০

শাঁকচুন্নি

শাঁকচুন্নি

বেশ কিছুদিন এ বিষয়ে চুপচাপ থাকবার পর আজ আমরা ফের ফিরছি ভূতালাপে। আমাদের আজকের আলোচনার মূলে আছেন এক মহিলা ভূতিনি। বঙ্গ সাহিত্যে এবং বাংলা কালচারে বেশ কিছু ফেমিনিন ভূতপ্রেতের খোঁজ পাওয়া যায়; তাদের মধ্যে যারা সবচাইতে বেশী পপুলার তেমনই একজন আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় – শাঁকচুন্নি।




 কে এই শাঁকচুন্নি?
শাঁকচুন্নি নামখানা এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘শঙ্খচূর্ণিকা’ বা ‘শঙ্খচূর্ণি’ থেকে। নামই বলে দেয় এদের সাথে শাঁখের একটি স্পষ্ট যোগাযোগ আছে। আমাদের বাংলার সংস্কৃতি অনুসারে প্রত্যেক বিবাহিতা মহিলা তাদের হাতে শাঁখার চুড়ি পড়ে থাকেন; সেরকমই বাংলার ভূতিনিদের মধ্যেও কেবলমাত্র শাঁকচুন্নিদেরই হাতে শাঁখা দেখা যায়। এ থেকে বোঝা যায় যে শাঁকচুন্নি হন সেই সব মহিলারা যারা বিয়ের পর সধবা অবস্থায় মারা গিয়ে থাকেন।


শাঁকচুন্নি

কেমন হয় শাঁকচুন্নিরা?

লোকগাথা অনুসারে বিবাহিতা মহিলারা মৃত্যুর পর শাঁকচুন্নি হন। তাদের হাতে থাকে শাঁখা, তাদের পরনে থাকে বাংলার রীতি অনুযায়ী সাদা ও লাল শাড়ি। বেশীরভাগ ভূতেদের মত তাদের শরীরও শুকিয়ে রোগা হয়ে যায় (এটা যে ঠিক কেন হয় তা আমি ঠিক বুঝিনা, এখনও পর্যন্ত আমি কোনও মোটা ভূতের খোঁজ পাইনি)। তারা সময়ে অসময়ে তাদের থাকবার জায়গায় গোবর জলের ছিটে দিতে পছন্দ করে; যেমনটা লেখক রাজশেখর বসু তার এক গল্পে লিখেছেন –
একটি শাঁকচুন্নি কয়েকবার শিবুর নজরে পড়িয়াছিল। সে একটা গামছা পড়িয়া আর একটা গামছা মাথায় দিয়া এলোচুলে বকের মত লম্বা পা ফেলিয়া হাতের হাঁড়ি হইতে গোবর গোলা জল ছড়াইতে ছড়াইতে চলিয়া যায়।

এ থেকেই আমরা শাঁকচুন্নি সম্পর্কে বেশ একটা ধারণা পেতে পারি। তারা সাধারণত আমগাছে থাকতে পছন্দ করে এবং বিবাহিতা ও ধনী গৃহবধূদের ঘাড়ে চাপতে পছন্দ করে যাতে নিজেরা সেরকম জীবন যাপন করতে পারে ও বিবাহিত সংসারের সুখ ভোগ করতে পারে। ঠাকুরমার ঝুলির গল্পগুলিতেও মাঝে মাঝে শাঁকচুন্নিদের দেখা পাওয়া যায়।

প্রেতেন্টারভিউ

[এই বিভাগে আপনারা একটি করে ইন্টারভিউ (অবশ্যই কাল্পনিক) পরবেন আজকের ইন্টারভিউ করা হয়েছে শাঁকচুন্নির যদিও সাধারণত ভূতেরা নাকি নাঁকি সুঁরে কঁথা বঁলে থাঁকেঁন, কিন্তু টাইপিং এর সুবিধার্থে চন্দ্রবিন্দুগুলি বাদ দেওয়া হল, দয়া করে কল্পনা করে নেবেন]

দেবলীনা নমস্কার দিদিইয়ে, মানে আপনাকে দিদি বলা যাবে তো?

শাঁকচুন্নি কওন যাইব, কওন যাইব বাপু, আইছো যখন দিদি, মাসি, পিসি সবই কওন যাইব এখন তোমার কামের কথাখান কি আসে ঝাইড়া কও তো দেখি বাপ!

দেবলীনা আচ্ছা আমার প্রথম প্রশ্ন, আপনাদের আমরা বাঙালিরা তো শাঁকচুন্নি নামে জানি কিন্তু দেশের অন্যান্য জায়গায় অথবা অন্যান্য দেশে আপনাদের সবাই কী নামে চেনে?

শাঁকচুন্নি এইডা একখান কথা হইল? অন্য জায়গায় আমগো লোকে কি কয় তা আমরা ক্যামনে জানুম?
শাঁকচুন্নি

দেবলীনা না, আপনারা যখন গিয়েছেন জানতে পারেননি? আপনাদের তো আর এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে আমাদের মানুষদের মত প্ল্যানিং, ছুটি, গোছগাছ, ট্রেন, বাস, প্লেন ইত্যাদির হ্যাপা পোয়াতে হয় না, ব্যাস্ইচ্ছে হলেই হাওয়ায় ভেসে চলে যাও

শাঁকচুন্নি যাহ, তা আবার হয় নাকি? হিঃহিঃহিঃহিঃতোমরা তাইর মানে আসল কথাখানই জানো না? শুনো মাইয়া, আমাগো বঙ্গে আগে নিয়ম আসিলো- কেউ যদি সমুদ্দুর পার হয় তাইলে তার জাত বোইল্যা কিসু আর বাইচ্যা থাকে না হেইডা নিয়মরে তো তোমরা এক্কেইরে গোল্লায় পাঠায়া দিসো কিন্তু আমাগো ভুতদের মধ্যে নিয়ম আসে, মরণের জায়গা থিক্যা বাইরে যাইলে তারে ভুতসমাজ থিক্যা বিতারন করা হয় তাই অন্য কোনও দ্যাশ তো দূর, আমারা কখনও অন্য কোনও রাজ্যেও যাই নাই, বুঝলা?

দেবলীনা এ ব্যাপারখানা আমার একেবারেই জানা ছিল না আচ্ছা, আমার পরের প্রশ্ন- আপনারা, মানে শাঁকচুন্নিরা সবসময় আমগাছে বাসা বানান কেন?

শাঁকচুন্নি হেইড্যা না জানো আমি নিজেও জানি না, কিন্তু ওই যে কইলাম, নিয়ম আমরা তো আর তোমাগো মতন কথায় কথায় নিয়ম ভাইঙ্গ্যা কেত লওন পসোন্দো করি না, আমাগো আগের শাকসুন্নিরা সব আমগাছে থাকত, আমরাও থাকি

দেবলীনা আচ্ছা দিদি, মৃত্যুর পর শাঁকচুন্নি হবার পর আপনি যদি আপনার জীবদ্দশা সম্পর্কে আপনার অনুভুতি একটু শেয়ার করতেন

শাঁকচুন্নি – (হাঁউমাঁউ করে খানিক্ষন কাঁদে) এ আমায় তুই কি প্রশ্ন শুধাইলি রে মাইয়া আমার বুকখান যে কষ্টে ফাইট্যা পরতেসে ও হো সংসার বাইচ্যা থাকলে আমার চক্ষু ফাইট্যা কতই না জল পড়ত নেহাত মইরা গেসি বইল্যা চক্ষু দুইখান শুকনা শুকনা দেখাইতেসে কি সুখেরই না সিলো সেই সব দিনগুলান আহা রে আমার পোলা মাইয়া দুইড্যা কতই বদমাইশি করত সারাটা দিন কিন্তু আমারে না পাইলে ওগো চলতো না আমার সোয়ামিখানও বড়ই ভালোমানুষ গো কিন্তু পোলাপান কি আর মানুষ করতে পারবো…? ঘরের কোনও কামও তো ঠিকঠাক কইরা উঠতে পারত না হায় হায় ইস্‌, মানুষডা তো শুনসি আর বিয়াসাদিও করে নাই করলে সোজা গিয়া নতুন বউডার ঘাড়ে চাইপ্যা আমিই সব কইরা দিতাম কিন্তু তাও তো আর হইলো না গো

দেবলীনা আচ্ছা-আচ্ছা, ঠিক আছে-ঠিক আছে, কাঁদে না-কাঁদে না, ষাট-ষাট আচ্ছা, ঠিক আছে, টপিক চেঞ্জ। আচ্ছা, এই যে আমাদের মধ্যে কোরোনা নামের নতুন রোগটা এসেছে, যার ফলে আমরা সারাটা পৃথিবী জুড়ে মানুষেরা সবাই নিজেদের ঘরে লক্‌ ডাউন হয়ে বসে আছি, এতে আপনাদের অসুবিধে হচ্ছে না? মানে পথে ঘাটে ভয় দেখানোর জন্যে কাউকে পাচ্ছেন না যে!

শাঁকচুন্নি – আরে ধুর মাইয়া, যারা এমনিতেই ভয় পাইয়া জুজু হইয়া আসে তাগো আবার ভয় দেখাওন লাগে নাকি? আর তোমাগো ভয় পাওয়াখানও বড়ই অদ্ভুত, একদিকে বেদম ভয় পাইতেসো আবার আরেকদিকে কি সব উল্টাপাল্টা কামধাম করতেসো। কয় কিনা কেউ কারও বেশী কাছে জাইবা না আর অন্যদিকে সব বাজারে গিয়া গুতাগুতি লাগাইসে। আর মাতালগুলানের তো কথাই নাই, মদ কেনার লইগ্যা যে লাইন দিতাসে চাকরীর পরীক্ষার ফর্ম বিলিতেও অত্ত লম্বা লাইন দ্যাখন যায় না।

দেবলীনা – না… মানে তা আপনি ঠিকই বলেছেন, কিন্তু…

শাঁকচুন্নি – আর কোনও কিন্তু কান্তা নাই মাইয়া, অনেক বইক্যা ফালাইসি তোমার লগে। এইবার যাও গিয়া, আর বকরবকর করলে ঘাড় মটকাইয়া দিমু কিন্তু! আমার এখন এই জায়গায় গোবর ছড়া দেওন লাগব। ভাগো!



এই ইন্টারভিউখানা শুনতে বা কাউকে শোনাতে চাইলে নীচে দেওয়া এমপিথ্রি ফাইলে শুনতে পারেন :




<<Previous Article                        <Main Introductory Page>                        Next Article>>

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন