আমাদের আজকের আলোচনা এমন
একজনকে নিয়ে যার সাথে প্রথমবার আমাদের পরিচয় তো নিঃসন্দেহে একজন সাহিত্যিক তার
গল্পের মাধ্যমে করিয়েছিলেন বটে, কিন্তু তাকে দেশ তথা বিশ্ববাসীর কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন
সেই লেখকের পৌত্র একটি সিনেমার মাধ্যমে; এবং ধীরে-ধীরে তার সেই জনপ্রিয়তা এমন
এক পর্যায় পৌঁছে যায় যে সেই বিশেষ ভূতটির নাম বললে দেশবাসীর সেই লেখকের নাতির কথাই
মনে পড়ে যিনি সিনেমাটি বানিয়েছিলেন। আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, আমার আজকের
লেখা ভূতের রাজা কে নিয়ে।
ভুতের রাজা চরিত্রটি প্রথম সৃষ্টি করেন প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক
শ্রী উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি তার গল্প ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’-এ ১৯১৫ সালে
তার ‘সন্দেশ’ পত্রিকার জন্য।
১৯৬১
সনে যখন তার পৌত্র শ্রী সত্যজিত রায় পত্রিকাটি আবার চালু করেন তখনই এই গল্পটির ওপর
ছোটদের জন্যে একটি সিনেমা বানানোর কথা তার মাথায় আসে এবং ১৯৬৯ সালে নানারকম বাধা অতিক্রম
করে তিনি সিনেমাটি রিলিজ করেন। সেই সিনেমা এবং তার গুপি, বাঘা ও ভূতের
রাজা চরিত্রগুলি এতটাই জনপ্রিয়তা পায় যে পরবর্তীতে ১৯৮০-তে ‘হীরক রাজার দেশে’ এবং ১৯৯২-তে ‘গুপি-বাঘা ফিরে এলো’
নামে সিনেমাটির আরও দুটি সিকোয়েল তৈরী হয় এবং ‘গুপি-বাঘা ফিরে এলো’-তে ভুতের
রাজাকেও আবার ফিরে আসতে হয়।
এবার ফিরে আসা যাক যাকে নিয়ে আমাদের আজকের আলোচনা তার
কথায়।
যদিও
ভূতের রাজাকে প্রথম খুঁজে পাওয়া যায় উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরির গল্পে, তবে সেখানে
তাকে ‘ভূতের গোদা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল
এবং তার চেহারার তেমন কোনও বিবরণও গল্পে দেওয়া হয়নি। ভূতের রাজাকে প্রথম
রূপদান সত্যজিত রায়ই করেন এবং আজও ভূতের রাজা নামটি শুনলে আমাদের মানশচক্ষে তার তৈরী
করে দেওয়া চেহারাখানাই ভেসে ওঠে। এবং আজও এখানে আমরা ভূতের রাজা বলতে সত্যজিত রায় এর
দেখানো ভূতের রাজাকেই বিশ্লেষণ করব, আশা করি পরলোকগত শ্রী সত্যজিত রায় তার তৈরী
করা চরিত্র কে নিয়ে কাটাছেঁড়া করার অপরাধে আমায় দোষী ঠাহর করবেন না।
ভূতের রাজার চেহারাখানা বড়ই অদ্ভুতুড়ে- কালচে নীল
গায়ের রঙে, কুলোর মত কান ও মুলোর মত দাঁতে যাকে গিয়ে বলে একদম পারফেক্ট ভুতুড়ে চেহারা। তার আঙুলে বড়-বড় নখ ও সাদাটে
ভুরু ও চুলে বোঝা যায় যে বয়সখানা তার ভালই। সারাটা মুখ ও শরীর
জুড়ে ছোট-ছোট, গোল-গোল দাগ, পরনে খালি গায়ে কালো উড়ুনি ও মাথায় কালো রঙের টোপর; গলায়
ঝুলছে মোটাসোটা এক পৈতে। যখনই ভূতের রাজাকে দেখা যায় তার পেছনে এক আলোর তারা
জ্বলে-নেভে-জ্বলে-নেভে।
ভূতের
রাজার গলার পৈতে প্রমাণ করে যে সে আসলে এক ব্রহ্মদৈত্য; সাদা চুল
ও ভুরু বলে মৃত্যুর সময় তার বয়সখানা হয়েছিল ভালই; আর মৃত্যুর
কারণ?- কেন, সারাটা মুখ ও শরীর-ময় গোল-গোল দাগ! খুব সম্ভবতঃ বসন্ত
রোগে তার মৃত্যু হয়েছিল- দাগগুলি বোধকরি তারই প্রমাণ।
পুরোনো
দিনে ব্রাহ্মণদের বুড়ো বয়সেও বিয়ে করবার অভ্যাস (কিম্বা বদভ্যাস!) ছিল, এমনও শুনেছি মৃত্যুশয্যায় থাকা বৃদ্ধ ব্রাহ্মণও
কুলধর্ম পালন করার নামে বিয়ের পিড়িতে বসত এবং বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই ব্রহ্মদৈত্যত্ব
প্রাপ্ত করত। আমাদের ভূতের রাজাও খুব সম্ভবতঃ বসন্তরোগগ্রস্ত অবস্থায়ও
কুলধর্ম পালন করতে গিয়েছিলেন, তাই তার পরনেও বিয়ের পোশাক- যথা উড়ুনি, ধুতি ও মাথায় টোপর।
কিন্তু
শেষমেশ বিয়েটা বোধকরি করে উঠতে পারার আগেই বা করতে-করতেই তিনি পরলোকগত হয়েছিলেন তাই মৃত্যুর
পরও বরের পোশাকখানা তার গায়ে থেকে গিয়েছে।
![]() |
সত্যজিৎ রায় এর আঁকা 'গুগাবাবা'র পোস্টার এ ভুতের রাজা |
‘হবে-হবে-হবে-হবে-
গান হবে, ঢোল হবে,
সুর হবে, তাল হবে,
লয় হবে-
লোকে শুনে ভ্যাবাচ্যাকা
থির হয়ে থেমে যাবে।
থেমে যাবে, থেমে যাবে,
থেমে যাবে…।’
এই কথা বলার স্টাইলখানা একেবারেই সত্যজিত রায়ের বকলমে
ভূতের রাজার নিজস্ব যা চিরদিন অমর হয়ে থেকে যাবে।
প্রেতেন্টারভিউ
[এই বিভাগে আপনারা একটি করে ইন্টারভিউ
(অবশ্যই কাল্পনিক) পরবেন।
আজকের
ইন্টারভিউ করা হয়েছে ভূতের রাজার। যদিও সাধারণত ভূতেরা নাকি নাঁকি সুঁরে কঁথা বঁলে
থাঁকেঁন,
কিন্তু টাইপিং এর সুবিধার্থে চন্দ্রবিন্দুগুলি বাদ দেওয়া হল,
দয়া করে কল্পনা করে নেবেন।]
ঋতম – রাজামশাই, রাজামশাই, আপনি আছেন? থাকলে একটু আসবেন কি দয়া করে?
ভূতের রাজা – কে রে-কে রে-কে রে-কে রে-
ডাকে কে রে আজ মোরে
দেখি বহুদিন পরে।
দাঁড়া যাই, দাঁড়া যাই,
দাঁড়া যাই।
ঋতম – আজ্ঞে আমার নাম ঋতম। আমার একখানা ব্লগ আছে যেখানে আজকাল আমি আপনাদের, মানে ভূতপ্রেতদের নিয়ে একটু লেখালিখি করছি। তা সেটার জন্যে আপনার একটা ইন্টারভিউ নিতে চাই।
ভূতের রাজা – বাঃ তা বেশ,
বাঃ তা বেশ,
গুপি ডেকেছিলো শেষ,
চলছে যে তারই রেশ-
চলছে যে তারই রেশ-
তারই রেশ, তারই রেশ,
তারই রেশ।
ইন্-ভিউ, টার্-ভিউ,
মিলে ইন্টারভিউ-
দেবো, দেবো, খুব দেবো-
সওয়ালে জবাব দেবো।
বল্ বল্ কি শুধোবি?
যা চাস্ জান্তে চাবি,
লিখে নিয়ে ব্লগে দিবি-
ব্লগে দিবি, ব্লগে দিবি,
ব্লগে দিবি…।
ঋতম – আজ্ঞে আমার
প্রথম প্রশ্ন- এই যে আপনি সারাটা পৃথিবী-জুড়ে এত বিখ্যাত হয়েছেন, বিশেষতঃ বাংলায় তো আপনি প্রায়
সুপারস্টার; এতে আপনার কেমন লাগে?
ভূতের রাজা – লাগে-লাগে-লাগে-লাগে-
লাগে তো ভালোই বাবা,
কতোটা যায় না ভাবা,
গিয়ে যে সবারে কবা-
করলে লোকের ভালো
ভালো হয়, ভালো হয়,
ভালো হয়।
ভালো ছেলে ভালো তাই
করেছি, বর দিয়েছি-
গান গাবে, খাবে, দাবে,
আর যে দেশ বেড়াবে।
বলে যে সবাই তাই
আমি ভালো, বাঘা ভালো,
গুপি ভালো…।
ঋতম – আচ্ছা,
সেই যে গুপি-বাঘা, তার পর
আপনি আর কাউকে কখনও কোনও বর দেননি। এমনটা কেন?
ভূতের রাজা – দিনি কেনো?
দিনি কেনো?
কাউকে পাইনি জানো!
ভালো ছেলে, পুরো ভালো
মনেতে নাই যে কালো
কালো নাই, কালো নাই,
কালো নাই-
যবে যে আবার পাবো,
তিন্ বর তাকে দেবো-
এক্ বর, দুই বর,
তিন্ বর…।
ঋতম – না, মানে, আমাকে দিন না তিন বর। আমিও ছেলে বেশ ভালই…। না, মানে সবাই তো তাইই বলে, হেঁ, হেঁ, হেঁ!
ভূতের রাজা – দূর্
হ ব্যাটা! তুইও পাজি!
তোকে দিতে নই রাজি।
সব কাজের যে কাজি-
তুই ছেলে যে বিশেষ
ভালো নোস্, ভালো নোস্,
ভালো নোস্-
হোলো, হোলো, বেশ্,
বেশ্,
এবারে সময় শেষ্
ইন্টারভিউও শেষ্।
আর তোকে আমি কিছু
কোবো নাকো, কোবো নাকো,
কব না…।
আমি আসি, আমি আসি,
আমি আসি, আমি আসি,
আমি আসি…।
(ভূতের রাজা উইদ্ হিস্ ত্রিকোণ আলো অদৃশ্য হয়ে যান)
ইন্টারভিউটি শুনতে চাইলে এখান থেকে শুনতে পারবেন (চাইলে ডাউনলোড করে নিয়ে কাউকে শোনাতেও পারবেন)-
- Cartoon Illustrations: Ritam Ghosal
<<Previous Article <Main Introductory Page> Next Article>>
বাঃ বাঃ বেশ বেশ
উত্তরমুছুন