মঙ্গলবার, ২৭ জুলাই, ২০২১

বারমুডা ট্রায়াঙ্গল

 বারমুডা ট্রায়াঙ্গল

 

পৃথিবীর নানান রহস্য নিয়ে কথা বলতে গেলে যে নামটা সবার আগে উঠে আসে তা হল বারমুডা ট্রায়াঙ্গল। বারমুডা ট্রায়াঙ্গল ইউনাইটেড স্টেটস্‌ এর দক্ষিণ-পূর্ব কোস্ট এ আটলান্টিক মহাসাগরে অবস্থিত। যেমনটা নামেই বোঝা যায়, এই ক্ষেত্রটি ত্রিকোণাকৃতি- বারমুডা, ফ্লোরিডা ও পোয়ের্তো রিকো মিলে প্রায় ৫০০০০০ বর্গ মাইল একটি ত্রিকোণ ক্ষেত্র রচনা করে, যা বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নামে পরিচিত।

 

বারমুডা ট্রায়াঙ্গল
বারমুডা ট্রায়াঙ্গল (Image Courtesy- Wikipedia)

বারমুডা ট্রায়াঙ্গলকে পৃথিবী সবথেকে রহস্যময় স্থানগুলির মধ্যে গণ্য করা হয় কেন? কারণটা হয়ত অনেকেই জানেন- কোনও অজ্ঞাত কারণে এখানে গেলেই জাহাজ, নৌকো, এরোপ্লেন, ইত্যাদি কোথায় যেন গায়েব হয়ে যায়; তা আর কোনওদিন খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার কখনও কখনও যানটিকে অবিক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়, কিন্তু তাতে থাকা লোকজন আর থাকেনা- যেন কেউ তাদের মুছে দিয়েছে! তবে এমনটা যে সবসময় হয় তাও নয়, মাঝে মাঝে হয়- কখন যে এখানে কে গায়েব হবে কেউ জানে না, আর এটাই রহস্য! শোনা যায় এ যাবৎ প্রায় ৭৫টি বিমান, ১০০র উপরে জলযান এবং এক হাজারের কাছাকাছি লোকজন এখানে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছেন। এজন্য জায়গাটিকে ডেভিলস্‌ ট্রায়াঙ্গল, ভুডু সি, অথবা লিম্বো অফ দি লস্টও বলা হয়ে থাকে।

 

রহস্যপঞ্জি

 

এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্য সম্প্রতি শুরু হয়নি কিন্তু, এই স্থানের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় প্রখ্যাত অভিযাত্রী ক্রিস্টোফার কলম্বাস এর লেখায়। তিনি উল্লেখ করেছেন যে যখন আটলান্টিক মহাসাগরের এই স্থান দিয়ে তার জাহাজ যাচ্ছিল তখন হঠাৎ তিনি এক বিশাল অগ্নিগোলক (উল্কাপিণ্ড কি?) আকাশ থেকে সমুদ্রে পড়তে দেখেন, এবং তার দু দিন পরও সেখানে অদ্ভুতরকমের আলো দেখতে পাওয়া যায়। তিনি এটাও বলেন যে এই স্থান পার করবার সময় তার জাহাজের সব কম্পাসগুলি অদ্ভুতভাবে বিকল হয়ে উল্টোপাল্টা দিকনির্ণয় করেছিল, যা পরে নিজে থেকেই ঠিক হয়ে যায়।

 

আরও পড়ুন- আমাদের মহাকাশযান অবতরণ করল ভিনগ্রহে


বারমুডা ট্রায়াঙ্গল এর নাম এর পর উঠে আসে ১৮৭২ সালে যখনমেরি সেলেস্টনামের একটি জাহাজকে আটলান্টিক মহাসাগরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। জাহাজটিতে কোনও রকমের আঘাতের চিহ্ন বা ক্ষতি ছিল না, কিন্তু তার সাতজন কর্মী, ক্যাপ্টেন এবং তার পরিবারের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি; তাদের কোনও ব্যবহার্য এবং লাইফবোট গুলিও জাহাজে ছিল না; শুধু ডেক এ একটি তলোয়ার পড়ে ছিল।

 

১৮৮১ সালেএলেন অস্টিননামের একটি জাহাজ নিউইয়র্কে ফেরার পথে এই এলাকায় একটি জাহাজ দেখতে পায়। জাহাজটির কাছে গিয়ে দেখা যায় তাতে কোনো মানুষ নেই, এছাড়া জাহাজে কোনরকমের কোনও ক্ষতি দেখতে পাওয়া যায় না। অস্টিন জাহাজের ক্যাপ্টেন সেই অজানা জাহাজটিতে তার কিছু ক্রিউ কে পাঠিয়ে তাকে ফিরিয়ে আনতে চান, কিন্তু মাঝপথে জাহাজটি আবার হারিয়ে যায়। কিন্তু ঘটনাটা এখানেই শেষ হয়ে যায়নি- কিছুদিন পর তাকে আবার পরিত্যক্ত অবস্থায় ঘুরতে দেখা যায়। নতুন কর্মীরাও কোথায় যেন উধাও হয়ে গিয়েছে- জাহাজ আবার ফাঁকা!


 আরও পড়ুন- আমাদের মহাকাশযান অবতরণ করল ভিনগ্রহে (দ্বিতীয় ভাগ)


১৯১৮ সালেইউ এস এস সাইক্লপস্‌নামের আমেরিকান নৌসেনার ৫৪২ ফুটের একটি বিশাল মালবাহী জাহাজ এখানে এসে হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে যায়। জাহাজটিতে ৩০০ জন কর্মী এবং প্রায় ১০০০০ টন ম্যাঙ্গানিজ আকরিক ছিল; অদ্ভুতভাবে জাহাজটি থেকে কোনও এস ও এস সিগন্যালও করা হয়নি যা কোনও বিপদে পড়লে তাদের করা উচিত ছিল। জাহাজটিকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

 

১৯২১ সালেক্যারল এ ডিয়ারিংনামের একটি জাহাজকে রওনা দেওয়ার কিছুদিন পর নর্থ ক্যারোলিনার হ্যাটেরাস ডায়মন্ড শোলস্‌ এর পাথূরে তীরে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ভেসে বেড়াতে দেখা যায়। খোঁজকর্তার দল খবর পেয়ে জাহাজটিতে গিয়ে দেখেন- খালি জাহাজ, কিন্তু তাতে কোনও লোক নেই, এবং তাদের ব্যবহারের জিনিসপত্র, নেভিগেশনাল যন্ত্রপাতি, লগবুক, লাইফবোট, এসবও নেই; সব যেন উধাও হয়ে গিয়েছে। এ রহস্যও ভেদ করা যায়নি।

 

বারমুডা ট্রায়াঙ্গল
ক্যারল এ ডিয়ারিং জাহাজ (Image Courtesy- Wikipedia)

১৯৪১ সালেইউ এস এস সাইক্লপস্‌এর মত আরও দুটি জাহাজ ভ্যানিশ হয়ে যায়, তারাও কোনও এস ও এস সিগনাল দেয়নি। কিন্তু এরপর যে বড় ঘটনাটি সামনে আসে তা ১৯৪৫ সালে। সে বছর আমেরিকান নৌসেনার পাঁচটি বোমারু বিমান ১৪ জন লোককে নিয়ে এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রদর্শন করছিল, হঠাৎ তাদের কম্পাসগুলি গন্ডগোল করা শুরু করে এবং এই দলের মুখ্য বিমানটি এর ফলে কোথাও নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। বাকি চারটি বিমানও জ্বালানি শেষ হওয়া পর্যন্ত উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে পরে নিখোঁজ হয়ে যায়। তাদের খোঁজ করতে নৌসেনার তরফ থেকে একটি রেসকিউ বিমান পাঠানো হলে সেটিও আর কোনওদিন ফিরে আসে না।

 

বারমুডা ট্রায়াঙ্গল
আমেরিকান নৌসেনার বোমারু বিমান (Image Courtesy- Wikipedia)

১৯৬৭ সালেউইচক্র্যাফ্‌টনামের একটি কেবিন ক্রুইসার এর ক্যাপ্টেন মিয়ামি সমুদ্রতট থেকে এক মাইল দূরে থাকাকালীন কোস্টগার্ডকে খবর দেন যে তার জাহাজ কিছুর সাথে ধাক্কা খেয়েছে কিন্তু তিনি কিছু দেখতে পাচ্ছেন না, তার জাহাজের কোনওরকম ক্ষতিও হয়নি। ঠিক ১৯ মিনিট পর কোস্টগার্ড উল্লেখিত স্থানে পৌঁছে দেখে কোনও জাহাজ নেই। আশেপাশের ১০০ বর্গমাইল সমুদ্রে সন্ধান করেও উইচক্র্যাফ্‌ট এর খোঁজ আর পাওয়া যায়নি।


 আরও পড়ুন- ষড়যন্ত্রতত্ব


১৯৭০ সালে ব্রুস গার্নন নামের এক পাইলট তার বিমান নিয়ে উড়ে এই এলাকা পার করছিলেন। হঠাৎ তিনি লক্ষ্য করেন যে আশেপাশে ডুনাট (Donut) এর আকারের ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হচ্ছে যা অ্যান্টিক্লকওয়াইজ ঘুরছে; বিদ্যুতের ঝলকানির সাথে সাথে চারিদিকে হলুদ রংয়ের কুয়াশা ছড়িয়ে পড়ছে; এর সাথে সাথে প্লেনের যন্ত্রপাতিও গড়বড় করা শুরু করে এবং ব্রুসের সারা শরীর জুড়ে কেমন অস্বস্তিও শুরু হয়। প্রায় তিন মিনিট ধরে এমন চলার পর তার রাডার কন্ট্রোলার সংযোগ ফিরে পায় এবং তিনি মিয়ামি এয়ার কন্ট্রোল এর সাথে যোগাযোগ করে হতবাক হয়ে যান- তারা বলে তাকে প্রায় তেত্রিশ মিনিট ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না; এই তিন মিনিটে প্রায় এক ঘন্টা কেটে গিয়েছে!

 

এছাড়াও এমন আরও প্রচুর ঘটনা হয়ে গিয়েছে। সব তো লেখা সম্ভব নয়, তবে সবচাইতে সাম্প্রতিক ঘটনাটা ঘটেছে ডিসেম্বর ২০২০তে, যখন কুড়িজন যাত্রীকে নিয়ে একটি বোট এখানে নিখোঁজ হয়ে যায়।

 

কিন্তু কেন?

 

বছরের পর বছর ধরে এত লোকজন এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল এ গিয়ে রহস্যময়ভাবে নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে তার কারণটা কি? আজ পর্যন্ত কেউ সঠিকভাবে এর উত্তর দিতে পারেনি। কেউ একে প্যারানর্মাল ঘটনা বলে মনে করেন, কেউ বলেন এর সাথে ভিনগ্রহীদের যোগ রয়েছে। বিজ্ঞানীদের একদল বলেন যে এটা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইন্টারফেয়ারেন্স এর ব্যাপার, অর্থাৎ কোনও কারনে এই এলাকার চৌম্বকত্ব অত্যন্ত বেশি যার ফলে কম্পাসগুলি গোলমাল শুরু করে এবং জাহাজেরা দিকভ্রম করে হারিয়ে যায়। কিন্তু খালি জাহাজ কিভাবে ফিরে আসে, বা তার লোকজন সব কোথায় যায় এর কোনও সঠিক ব্যাখ্যা তারা দিতে পারেন না।

 

২০১৬ সালে ইউনিভার্সিটি অফ কোলোরাডোর একদল বিজ্ঞানী স্যাটেলাইট এর মাধ্যমে লক্ষ করেন যে এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গল এলাকার ওপর ষড়ভুজাকার (Hexagonal) মেঘ জমা হচ্ছে। তারা বলেন যে এর ফলে এই এলাকায় হঠাৎ হঠাৎ প্রচন্ড ঝড় উঠতে পারে যেখানে প্রায় ১৭০ মাইল প্রতি ঘন্টা বেগে হওয়া চলাচল করে। তারা বলেন জাহাজ ও প্লেন নিখোঁজ হবার এটা একটা কারণ হলেও হতে পারে; কারন এটাও মনে রাখার মতো বিষয় যে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল এ গেলেই কোন জাহাজ গায়েব হয়ে যায় না, এমনটা মাঝেমধ্যে হঠাৎ করে হয়ে থাকে। কিন্তু ঝড়ে পড়া জাহাজ কি সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় আবার ফিরে আসে?

 

বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে আমাদের অ্যানসিয়েন্ট অ্যাস্ট্রোনট থিয়োরিস্টদের একাংশ মনে করেন যে এখানে ভিনগ্রহীদের যাতায়াত করবার কোন পোর্টাল রয়েছে যার মাধ্যমে উন্নততর ভিনগ্রহের জীবেরা আমাদের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন এবং মাঝে মধ্যে যাতায়াতও করে থাকেন। কখনও সখনও ভুলক্রমে কিছু জাহাজ সেই পোর্টাল অ্যাক্টিভেট করে ফেলে ও তার মধ্যে ঢুকে পড়ে। তবে এই বিশ্লেষণের ফলে দুটো প্রশ্ন মাথায় চলে আসে- ১) যারা এই পোর্টাল এ ঢোকে তারাও কি সেই অজানা ভিনগ্রহে চলে যায়? ২) এটা যদি একটা পোর্টাল হয়ে থাকে, তবে এমন পোর্টাল কি পৃথিবীতে আরও নানা জায়গায় রয়েছে? উত্তর জানা নেই।

 

বারমুডা ট্রায়াঙ্গল
(Image Courtesy- Gratiscography)

(তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট)

 

<<Previous Article            <Main Introductory Page>            Next Article>>

২টি মন্তব্য: