এখানে ক্লিক করে পড়ুন- বন্ধুমামার গল্পযান (প্রথম পর্ব)
এখানে ক্লিক করে পড়ুন- বন্ধুমামার গল্পযান (দ্বিতীয় পর্ব)
বন্ধুমামার গল্পযান
(তিন)
সেদিনের পর মাস দেড়েক আর মামার ঘরে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তার মাঝে আবার স্কুলের টেস্ট শুরু
হয়ে গেল, পড়াশোনার প্রচুর চাপ। ধীরে-ধীরে মামার ব্যাপারটা
মাথা থেকে উধাওই হয়ে গিয়েছিল। পরীক্ষা শেষ হবার কিছুদিন পর একদিন
স্কুল থেকে ফিরেছি, দেখি ঘরে আমার বইপত্তরের স্তূপের ওপর একটা চিরকুট রাখা, তাতে লেখা, ‘সময় পেলেই আমার ঘরে একবার আসিস—বন্ধুমামা’। বলা হয়নি, দরকারে অদরকারে মামা
এভাবেই চিরকুট রেখে আমায় ডেকে পাঠান। ঘোতন, রুমি কিংবা আর কেউ
এখনও জানে না মামার সাথে আমার এই সখ্যের কথা; আর আমিও বলিনি কাউকে,
পাছে মামার কাছে আমার স্থানখানার কোনও ভাগীদার হয়ে যায়!
চিরকুটখানা পেয়েই ছুটে যেতে চাইলুম মামার ঘরে, কিন্তু বাধ সাধল আমার
মা—‘এ্যাই বুবুন, না খেয়ে কোথাও যাওয়া চলবে
না কিন্তু বলে দিলুম। হাত-পা ধোওয়া নেই,
জামাকাপড় বদলানো নেই, কোনওমতে স্কুলব্যাগখানা ছুঁড়ে
ফেলেই বাবু ছুটলেন কোন চুলোয় কে জানে! শোনো, যেখানে যাবে
যাও, কিন্তু খাবার খেয়ে’। কী আর করা যাবে, কোনওক্রমে গোগ্রাসে
খাবার খেয়েই গেলুম বন্ধুমামার ঘরে। গিয়ে দেখি আগে যা দেখেছিলুম ঘরের অবস্থা
প্রায় সেরকমই আছে, শুধু সেই গাড়ির মত জিনিষটায় কী একখানা অ্যান্টেনা মত লাগানো হয়েছে,
আর সেই জেনারেটরটার পাশে আজ আরেকখানা যন্ত্র এসেছে। আজ দেখলুম মামা আর কোনও কাজে ব্যাস্ত
নন, কানে
হেডফোন লাগিয়ে দিব্যি মোবাইলে গান শুনছেন। বুঝলুম মামার এক্সপেরিমেন্ট সাকসেসফুল।
‘আয় বুবুন, আমি তোর জন্যই
অপেক্ষা করছিলুম,’ কান থেকে হেডফোনটা খুলে মামা আমায় ডাকলেন।
‘মামা, তোমার যন্ত্র তৈরী
হয়ে গিয়েছে?’
‘হ্যাঁ, তবে তার ভালমত
পরীক্ষা তোর একটু সহায়তা ছাড়া সম্ভব নয়’।
আমার মনে-মনে বেশ গর্ব হল যে মামার আবিষ্কারের পরীক্ষায়
আমায় দরকার হবে। তবে মনের ভাবখানা গোপন রেখে বললুম, ‘মামা তুমি এটা কী
বানিয়েছ?’
‘বলব, আজ তোকে সবই বলব,
আয় বোস। সেদিন তুই জিজ্ঞাসা করলি না এটা টাইম
মেশিন কিনা – না, এটা টাইম মেশিন নয়। তবে এ যন্ত্রের সাহায্যে অন্য ডাইমেনশান
বা লোকে যাত্রা করা যায়’।
‘অন্য ডাইমেনশান?’ অবাক
হয়ে বললুম। গুচ্ছের
কল্পবিজ্ঞানের গল্প পড়ার দরুন ডাইমেনশান ব্যাপারটা কী তা আমার ভালই জানা।
‘হ্যাঁ, কল্পলোক,
বা বলা ভাল গল্পলোক’, মামা বললেন। ‘আমার এই মাল্টি-ইম্যাজিনো-ডাইমেনশান-ট্র্যাভেলার
এর সাহায্যে একজন বা একাধিক জন গল্পলোকে ভ্রমণ করতে পারবে। অবিশ্যি তার জন্য কম্প্যুটার আর ওই
স্পিরিচুয়াল-ইম্যাজিনো-এক্সট্র্যাক্টর এ দরকারি তথ্য ফিড করতে হবে’।
‘তুমি কী বলছ মামা আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি
না’—বোকার মত মুখ করে বললুম।
‘হুঁ, দাঁড়া সহজ করে বুঝিয়ে
দিচ্ছি’। একটু
গুছিয়ে নিয়ে মামা বলা শুরু করলেন, ‘শোন, আমাদের সবার মস্তিষ্কে একটা
কল্পনার জগৎ আছে যেখানে আমরা নিজেদের অজান্তেই নিজের কল্পনাকে কাজে লাগিয়ে যা নয় তাই
করতে পারি; আর সৃষ্টিশীল লোকেদের এই কল্পনার জগৎখানা হয় সাধারণ
লোকেদের চাইতে আরও অনেক বেশী শক্তিশালী ও রহস্যময়। যখন কোনও লেখক কোনও গল্প লেখেন তখন
তার কল্পনার জগতে তার গল্পের ঘটনাগুলো ঘটতে থাকে, চরিত্রগুলো সব জীবন্ত হয়ে থাকে—এবং সেটা হয় এক ভীষণ স্পিরিচুয়াল এনার্জি বা অতিমানবিক শক্তির উৎস। আর মজার ব্যাপার হল লেখা শেষ হয়ে যাবার
পরও সেই এনার্জি প্রকৃতিতে থেকে যায় বহুযুগ অবধি। আমার এ যন্ত্র সেই এনার্জিকে খুঁজে
বের করে তা দিয়ে এক ভারচুয়াল ডাইমেনশান তৈরী করে কাউকে তাতে প্রবেশ করাতে সক্ষম’।
‘এবার বুঝলুম, কিন্তু মামা
যে সব লেখকেরা মারা গিয়েছেন তাদের স্পিরিচুয়াল এনার্জির খোঁজ তুমি পাবে কী করে?’
আমি জিজ্ঞাসা করলুম।
‘তুই খুবই বুদ্ধিমান বুবুন’, মামা বললেন। ‘ঠিক এই সমস্যার কাছে এসেই আমার কাজ
আটকে গিয়েছিল। তবে তার সমাধানও আমি বের করে ফেলেছি। তুই অ্যালকেমিস্ট্রি কি হয় বুঝিস?’
‘উমম্, একটু-একটু। ওই তন্ত্রমন্ত্র আর রসায়নকে মিলিয়ে…’।
‘একদম ঠিক বলেছিস’। মামা আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলা
শুরু করলেন, ‘সেরকমই প্রেতচর্চা ও পদার্থবিজ্ঞানের মিলিত ব্যাবহারে আমি আমার সমস্যার সমাধান
খুঁজে বের করেছি। বলতে পারিস আমি পদার্থবিজ্ঞানের এক নতুন অধ্যায় শুরু করেছি, তুই একে…স্পিরিজিক্স বলতে পারিস’।
‘কিন্তু সমাধানখানা কী?’
‘সমাধান ওই যে, আমার স্পিরিচুয়াল-ইমাজিনো-এক্সট্র্যাক্টর’। মামার ইশারার দিকে তাকিয়ে দেখি সেই
নতুন যন্ত্রখানা।
‘এটা দিয়ে মৃত লেখকের প্রেতাত্মা, যা পৃথিবীতে
এনার্জি হয়ে থেকে যায়, তার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে তা দিয়ে তার
স্পিরিচুয়াল এনার্জির খোঁজ পাওয়া যায়’।
‘এবার কী করবে মামা?’ আমি
যথারীতি আমার কৌতূহল প্রকাশ করলুম।
‘কী আর করব, এটাকে ভালমতন
পরীক্ষা করতে হবে। ভাবছি কোথায় যাওয়া যায়। বুঝলি, যন্তরখানা যখন বানাচ্ছিলুম
তোর দেওয়া সেই গল্পের বইয়ের লিস্ট থেকে একটা গল্পের কথা আমার মাথায় ঘুরছিল। যা দিকি কিছু বই নিয়ে আয়’। বলে মামা আমায় একখানা কাগজে কিছু বইয়ের
নাম লিখে দিলেন।
ঘরে যেতে যেতে আকাশ-কুসুম চিন্তাভাবনা মনে ঘুরপাক খেতে লাগল। কি জব্বর যন্তরই না বানিয়ে ফেলেছেন
বন্ধুমামা। গল্পজগতে
ভ্রমণযন্ত্র—গল্পযান। ছুট্টে গিয়ে বইগুলো নিয়ে মামা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললুম, ‘মামা তোমার ওই গল্পযানে
আমায় চাপতে দেবে না?’
‘গল্পযান—ভাল নাম দিয়েছিস
তো। তা
তোকে চাপতে দেব, নিশ্চয়ই। এনেছিস বই?’ বইগুলো নিয়ে তা থেকে একখানা বই বেছে হাতে
নিয়ে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বললেন, ‘তোর লিস্ট থেকে এই বইখানা
আমার বেশ ভাল লাগছে। দেখছি অনেক আজগুবি ঘটনা ও জীব-জন্তুর উল্লেখ আছে
এতে। চল, প্রথম দিন এনার কল্পনার
জগতেই ঢোকা যাক’। বলে মামা বইখানা হাতে নিয়ে কয়েকটা পাতা ওল্টালেন, তারপর কম্প্যুটারগুলোর
একটাতে গিয়ে খুটখাট কী সব যেন চাবি টেপা শুরু করলেন, খানিক পরে
আরেক কম্প্যুটারে গিয়ে আবার। আমি আর কী করি, এদিক-সেদিক ঘুরে-ঘুরে দেখতে লাগলুম। মিনিট পনের ধরে এসব কাণ্ড করবার পর
মামা হঠাৎ বলে উঠলেন,
‘হেলমেট আর বর্ম পড়ে নে বুবুন’।
নজরে পড়ল কোনার দিকে একটা টেবিলে বেশ কিছু অদ্ভুতরকমের
হেলমেট ও বর্ম রাখা রয়েছে। তা থেকে একটা নিয়ে হ্যাঁচোর-প্যাঁচোর করে পড়ে ফেলবার
পর মামার দিকে তাকিয়ে দেখি তিনিও তৈরি। সব দেখেশুনে মামা আমায় বললেন গিয়ে
সেই যানে বসতে আর নিজে সেটার গায়ে খুটখাট কী সব করতে লাগলেন। আমি ভয়ে-ভয়ে গিয়ে পেছনদিকের
একটা সিটে বসলুম। একটু পড়ে মামাও এসে বসলেন ও কী যেন একখানা লিভারে টান দিলেন
ওমনি হড়াস করে ওপরের ঢাকনাখানা বন্ধ হয়ে গেল। একটু পড়ে কেমন একটা শোঁ-শোঁ আওয়াজ হতে লাগল
ও আমার কেমন যেন শ্বাসকষ্ট হতে লাগল। কাতর নয়নে মামার দিকে তাকাতেই মামা
হাতে অভয়ের মুদ্রা করে একটা বোতামে চাপ দিলেন আর ওমনি পুরো চেম্বারটা একটা মিষ্টি গন্ধে
ভরে গেল; বুঝলুম, নতুন কোনও একটা গ্যাস ঢুকছে। এরপরই শ্বাসকষ্টটা কমে গেল।
‘তোকে বলা হয়নি’, মামা
বললেন। ‘আমরা যে গ্যাসে শ্বাসপ্রশ্বাস নিই, মানে অক্সিজেন,
তাতে এক ডাইমেনশান থেকে অন্য ডাইমেনশানে যাবার অসুবিধে। আসলে পার্থিব শরীরটাকে অপার্থিব জগতে
পাঠাই কিভাবে? তাই আমি এক নতুন ধরনের গ্যাস সৃষ্টি করেছি যাতে আমরা শ্বাসকার্য ঠিকই চালাতে
পারব, কিন্তু এতে শ্বাস নিলে আমাদের শরীরের কোষগুলোতে এমন কিছু
পরিবর্তন হবে যে আমরা অন্য লোকে যেতে পারব। তবে ভয়ের কিছুই নেই, অক্সিজেনের সংস্পর্শে
এলেই পরিবর্তনগুলো চলে গিয়ে আমরা আবার আগের মত হয়ে যাব’।
মামার কথা শেষ হতে-হতেই আমি টের পাচ্ছিলুম আমার সারাটা
শরীর জুড়ে কেমন একটা আচ্ছন্য ভাব আসছে, কিন্তু একটু পরেই তা আবার
উধাও হয়ে গেল। ইতিমধ্যেই আমাদের গল্পযান কেঁপে-কেঁপে উঠতে শুরু করেছে
আর চারিদিকে অদ্ভুত একটা শব্দ হওয়া শুরু হয়েছে। শব্দটা বাড়তে-বাড়তে ক্রমে কানে তালা
লাগবার জোগাড়; কিন্তু এক্ষেত্রে যেমন হয়ে থাকে, কানে তেমন কোনও যন্ত্রণা নেই। ঘুম, আমার হঠাৎ খুব ঘুম
পেতে লাগল…ব্যাস্, তারপর আমার আর কিচ্ছু
মনে নেই।
(চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন