শনিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২১

বন্ধুমামার গল্পযান (চতুর্থ পর্ব)

এখানে ক্লিক করে পড়ুন- বন্ধুমামার গল্পযান (প্রথম পর্ব)

এখানে ক্লিক করে পড়ুন- বন্ধুমামার গল্পযান (দ্বিতীয় পর্ব)

এখানে ক্লিক করে পড়ুন- বন্ধুমামার গল্পযান (তৃতীয় পর্ব)


বন্ধুমামার গল্পযান

(চার)

ঠিক কতক্ষণ পর আমার ঘুম ভেঙেছে জানিনা প্রথমে মনে হয়েছিল কত যুগ ধরে না জানি ঘুমুলুম, কিন্তু হাতঘড়ি দেখে বুঝলুম ঘুমিয়েছি মাত্তর দশ মিনিট মত মামার ঘুম তখনও ভাঙেনি শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছিল, উঠে দাঁড়াতে গিয়ে লক্ষ্য করলুম ওপরের ঢাকনাখানা কখন যেন নিজে থেকেই খুলে গিয়েছে চারিদিকে তাকিয়ে দেখি গল্পযন্ত্র আমাদের এক জঙ্গলের মাঝে এনে ফেলেছে জঙ্গলই বা বলি কী করে, বড় গাছপালা তেমন খুব একটা নেই দু-চারখানা গাছ আছে বটে, তবে ঘন ঝোপঝাড়ই বেশী


বন্ধুমামার গল্পযান (চতুর্থ পর্ব)


ইতিমধ্যে দেখি মামাও জেগে উঠেছেন খানিক এদিক ওদিক তাকিয়ে মামা হঠাৎইয়াহুবলে চিৎকার করে একটা লাফ দিলেন, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘চল বুবুন, ঘুরেফিরে দেখা যাক কোথায় কী আছে


কিন্তু মামা, আমরা যদি হারিয়ে যাই বা পথ ভুলে যাই তখন এই যন্ত্র কিভাবে ফিরে পাবো? আর কিভাবেই বা ফিরে যাব?’ আমি জিজ্ঞাসা করলুম


সব ব্যাবস্থা করা আছে বাপু, রোসো বলে মামা পকেট থেকে রিমোট কন্ট্রোলের মত কী একখানা বের করে তাতে চাপ দিলেন, আর ওমনি অত বড় যন্ত্রটা চোখের নিমেষে উধাও!


এটা কেমন ব্যাপার হল? এত্তবড় যন্ত্রখানা গেল কোথায়? এবার আমরা ফিরবই বা কিভাবে?’ আমি আতকে উঠে বললুম


এত চ্যাঁচাচ্ছিস কেন? ভয় পাবার কিছুই নেই, আমি এই রিমোটের বোতাম টিপে যানখানাকে আবার আমাদের ডাইমেনশানে পাঠিয়ে দিলুম সেটা এই মুহূর্তে আবার আমার ঘরে তার জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই রিমোটের বোতাম আবার টিপলেই তোর গল্পযান আবার যেখানে আমরা চাইব চলে আসবে’, মামা বললেন


নিশ্চিন্ত হয়ে এবার জায়গাটা এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখলুমঝোপঝাড়ই বেশী চারিদিকে, পশুপাখিও নেই বললুম, ‘মামা এটা কোথায় চলে এলুম, কেমন ফাঁকা-ফাঁকা লাগছে মনে মনে ভাবছিলুম মামার আবিষ্কার যদি সফল হয় তবে তো বেশ মুশকিলেই পড়া যাবে কারণ যে বইটা মামা পছন্দ করেছেন তা এক আজগুবি জগতের বিষয়েখানিকটা সায়েন্স ফিকশান ও রূপকথার মিশেল গল্পে হয়ত লেখক তেমন ভয়ংকর কিছু লেখেননি, কিন্তু কে জানে তার কল্পনার জগতে যদি কিছু খুঁজে পাই তো কী রূপে পাবো আগে ব্যাপারটা মাথায় আসেনি তাই মামাকে কোনও অস্ত্রশস্ত্রও আনার কথা মনে করানো হয়নি অবিশ্যি মামা বৈজ্ঞানিক মানুষ, তার কাছে আদৌ কি কোনও অস্ত্র আছে? মনে তো হয়না


কথাটা মামার কাছে পারতেই তিনি বললেন, ‘না রে, কোনও অস্ত্র তো আনা হয়নি, তবে তার কোনও দরকার আছে বলে মনে তো হয়না আমরা এখন কল্পলোকে আছি বটে, কিন্তু আমাদের শরীর তো আসলে আমার ল্যাবেই বসে আছে আর আমার ক্যালকুলেশান যদি ঠিক হয় তবে এ জগতে আমাদের কোনও কারণে মৃত্যু হলে অটোমেটিকালি আমরা বাস্তব জগতে ফিরে যাব হ্যাঁ, তবে চোট লাগলে ব্যাথা পাবি, তবে সেটা তেমন কোনও ব্যাপার নয় বলে মামা এগিয়ে গেলেন


ব্যাথা লাগাটা কোনও ব্যাপার নয়! আর যদি মামার ক্যালকুলেশান ভুল হয় তবে? কি আর করা যাবে, দেখাই যাক’, ভাবতে ভাবতে মামার সাথে সাথে এগোতে লাগলুম


বেশ খানিকটা হাঁটার পর থেকেই লক্ষ্য করলুম জঙ্গুলে জমি শেষ হয়ে আমরা পাথুরে জমিতে এসে পড়েছি চারিদিকে এখন এবড়ো-খেবড়ো পাথর আর ছোট বড় টিলা চলছি তো চলছিই, পথ যেন আর শেষই হতে চাইছে নাএ আবার কেমন কল্পনায় এসে পড়লুম রে বাবা! পথ যে আর শেষই হচ্ছেনা আচ্ছা, কল্পনায় কি আমাদের খিদে তেষ্টাও পাবেনা নাকি? আর ছোট কিংবা বড় বাইরে? পেলে তো বড়ই বিপদের কথা হয়ে পড়বে মামা তো আবার এ বিষয়ে কিছুই বলেন নি জিজ্ঞাসা করে দেখব? উনি নিজেও কি এ ব্যাপারে আদৌ কিছু জানবেন? উনিও তো মনে হয় আমারই মত এই কল্পলোকে প্রথম এসেছেন’—এই সব আকাশ কুসুম কথা চিন্তা করতে করতে কতক্ষণ যে হেঁটেছি বলতে পারবনা এ সময়টা মামা আমার সাথে একটা কথাও বলেননি তবে একটা জিনিষ লক্ষ্য করছি যে এতটা পথ হাঁটলুম কিন্তু আমার পায়ে তেমন ব্যাথা ট্যাথা করছেনা, খুব একটা ক্লান্তিও বোধ করছিনা


হঠাৎ চলতে চলতে মামা থেমে পড়লেনভুরু কোঁচকানো, চোখে মুখে একটা সিরিয়াস ভাব মনে হচ্ছে খুব মন দিয়ে কিছু শোনার চেষ্টা করছেন আমাদের চারিদিকে এখন শুধু বড়-বড় পাথর, টিলা আর পাহাড়, গাছ গাছালির চিহ্নমাত্রও নেই, শুধু পাথরের ফাঁকে-ফাঁকে কোথাও কোথাও হলদেটে ঘাস উঁকি দিচ্ছে মামা আমায় উত্তেজিত স্বরে বললেন, ‘বুবুন, শুনতে পারছিস?’


প্রথমটায় তো আমি কিছুই শুনতে পেলুম না, কিন্তু পরে কান খাড়া করে শুনলুম কোথাও যেন একটা গুম-গুম শব্দ হচ্ছে, আর অনেক লোকজনের কথাবার্তার শব্দতবে তা বেশ অনেকটা দূরে, তাই খুব হালকা শোনা যাচ্ছে


মামা আবার হাঁটতে শুরু করে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি পা চালা বুবুন, কল্পলোকের প্রথম প্রাণীতা মানুষই হোক বা আমাদের চেনা অচেনা কোনও জন্তু, আমরা শিগগিরই তার সন্ধান পেয়ে যাব মনে হচ্ছে


কোনও উত্তর না দিয়ে হাঁটার গতি বাড়ালুম দুজনেই, আর আমি দুরুদুরু বক্ষে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলুমকী জানি কখন কী এসে হাজির হয় শব্দ লক্ষ্য করে আরও বেশ খানিকটা হাঁটার পর দেখলুম দূরে একখানা গুহা মত দেখা যাচ্ছে আর শব্দগুলো তার কাছ থেকেই আসছে, কারণ শব্দের জোর আগের থেকে বেড়ে গিয়েছে হাঁটতে হাঁটতে গুহার কাছে গিয়ে দেখি শব্দ পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু লোকজন জীবজন্তু কিছুই কোথাও নেই


মামা বললেন, ‘চল বুবুন, গুহার ভেতরে ঢুকে দেখতে হবে ব্যাপারখানা কি বাইরে তো কোথাও দেখছি কিছুই নেই


হাঁ করে খানিক্ষণ সেই পাহাড় সংলগ্ন বিশাল গুহার দিকে চেয়ে রয়ে বললুম, ‘কিন্তু আওয়াজগুলো তো ওর ভেতর থেকেই আসছে মামা


মামা এদিক সেদিক ঘুরে ফিরে গুহাটাকে ভাল করে নিরীক্ষণ করে বললেন, ‘আরে এ তো ব্র্যাঞ্চওয়ার্ক কেভ বলে মনে হচ্ছে, তার মানে এর আরও একাধিক গুহামুখ থাকবে


সে আবার কী মামা?’ জিজ্ঞাসা করলুম


গুহার নানা প্রকারের মধ্যে এটা একটা এই ব্র্যাঞ্চওয়ার্ক গুহার অনেকগুলি করে মুখ বা প্যাসেজ থাকে যা গিয়ে এক জায়গায় মিলিত হয় ব্যাপারটাকে খানিকটা গাছের ডালের মত মনে করতে পারিসঠিক যেমন গাছের বিভিন্ন ডাল বা শাখা প্রশাখা গিয়ে গাছের কাণ্ডে মিলিত হয়, তেমনি এ ধরনের গুহারও একাধিক শাখা থাকে


বাহ্মামা বিজ্ঞান ছাড়াও কত কিছু জানেন’, মনে মনে ভাবলুম


মামা আবার বলা শুরু করলেন, ‘এ গুহাখানাও সেই ব্র্যাঞ্চওয়ার্ক কেভ বলেই মনে হচ্ছে হয়ত এই শব্দের উৎস গুহার অন্য কোনও মুখে আছে চল, বাইরে গিয়ে গুহার পাশ দিয়ে আমরা এগোই কিন্তু খুব সাবধান, অন্য পাশে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করে আছে জানিনা, কিছু দেখলেই লুকিয়ে পড়বি চট করে


কান খাড়া করে দুজনে গুহার ধার ঘেঁসে এগোতে লাগলুম বুক দুরুদুরু করছে, কখন যে কিসের সামনে গিয়ে পড়ব কেউ জানিনা যত এগোচ্ছি সেই দুমদুম শব্দখানা যেন বেড়েই চলেছে আর যেন বহু লোকের উত্তেজিত কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু কিছুই বোঝা যাচ্ছেনা গুহার আরেক মুখের কাছে আসতেই মামা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন আমাকেও ইশারা করলেন দাঁড়াতে দেখলুম মামা খুব সাবধানে দেওয়ালের ধার দিয়ে উঁকি দিয়ে কী যেন দেখছেন খুব কৌতূহল হল, আমিও ধীরে-ধীরে গিয়ে মামার পাশ দিয়ে উঁকি দিলুম দেখি গুহামুখে প্রায় ত্রিশ চল্লিশ জন লোক দাঁড়িয়ে তাদের হাতে পৌরাণিক যুগের অস্ত্রশস্ত্রঢাল, তলোয়ার, তীর, ধনুক ইত্যাদি তাদের পরনের জামা কাপড়ও যেন কেমনধারা, আমরা ছবির বইয়ে রাজা রাজড়াদের যেমন ধুতি ও খালি গায়ে অলংকার পরা দেখি তেমন নয় তারা গায়ে ফতুয়ার মত এক জামা ও পাজামা জাতীয় কী একটা পরা আর তাদের সবার গায়ে উল্কি দেখে মনে হচ্ছে তারা সবাই সৈনিক আশেপাশে বেশ কিছু ঘোড়া, গাধা ও খচ্ছর বাঁধা তবে হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে পশুগুলো কোনও কারণে খুবই উত্তেজিত অবিশ্যি শুধু পশুগুলো কেন, তাদের সাথের লোকগুলোও খুব উত্তেজিততারা থেকে থেকেই চিৎকার করে কোনও অজানা ভাষায় কিছু বলছে, মনে হচ্ছে জয়ধ্বনি দিচ্ছে আবার কেউ কেউ তাদের হাতের অস্ত্রগুলোকে উত্তেজনার বশে মাটিতে ঠুকছে একটু দূরে দাঁড়িয়ে চারজন চারটে বিশাল জয়ঢাক বা দামামা জাতীয় বাজনায় তাল ঠুকছে যার ফলে সেই দুমদুম শব্দটা হচ্ছে মোটের ওপর সব মিলিয়ে বেশ উত্তেজনাপূর্ণ দৃশ্য আফসোস শুধু একটাই, লোকগুলো যে কী বলে চিৎকার করছে তার বিন্দুবিসর্গও আমরা বুঝতে পারলুম না ভাবলুম এ হয়ত আমার অজানা কোনও ভাষা ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘মামা ওরা কী বলছে?’


তা কি ছাই আমিও বুঝতে পারছি?’ মামা ব্যাজার মুখে বললেন, ‘আমার আগে থেকেই ভাবা উচিত ছিল যে ইমাজিনো ডাইমেনশানের কথাবার্তার ভাষা আমাদের জানা নাও হতে পারে কী আর করা যাবে, এ যাত্রায় এখানকার কথাবার্তা হয়ত আমরা কিছুই বুঝতে পারবনা তবে ফিরে গিয়ে এ সমস্যাটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করতেই হবে কল্পনার দুনিয়ায় এসে যদি কারোর সাথে কমিউনিকেটই না করতে পারলুম তবে আর কী লাভ


একদিকে কান খাড়া করে মামার কথাগুলো শুনছিলুম কিন্তু চোখ ছিল লোকগুলোর দিকে তাদের হাবভাব দেখে মনে হল তারা গুহার ভেতর থেকে কিছু একটা বাইরে আসার অপেক্ষায় উশখুশ করছে আলতো করে মামার হাতে একটা চাপ দিলুম, মামা চুপ করে গিয়ে আবার লোকগুলোর দিকে মন দিলেন হঠাৎ গুহার ভেতর থেকে একটা বীভৎস জান্তব চিৎকার ভেসে এল, এ চিৎকার কোনও মানুষের হতেই পারেনা খানিক পড়ে আবার আরেকখানা চিৎকার, সেই আওয়াজের প্রবলতা এতটাই ছিল যে এত দূর থেকেও আমরা শিহরিত হয়ে উঠলুম তাকিয়ে দেখি দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পশুগুলো তাদের বাঁধন ছিঁড়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টায় প্রাণপণ লাফালাফি করছে আর তাদের সাথে থাকা লোকগুলো তো আতংকে বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে যেন পাথর হয়ে গিয়েছে


(চলবে)


<<পড়ুন পূর্ববর্তী পর্ব<<                                                     >>পড়ুন পরবর্তী পর্ব>>

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন