মঙ্গলবার, ১৭ আগস্ট, ২০২১

মেছোভূতের দেখা পাওয়া

প্রেতেন্টারভিউ - মেছোভূতের দেখা পাওয়া

 

মাছ আমি খুব ভালো চিনিনে, এজন্য প্রায়ই গিন্নীর কাছে গঞ্জনা শুনতে হয়- বাঙালি হয়ে ভালো মাছ কিনে আনতে পারিনে বলে। আমার বাবা ও শ্বশুরমশাই মাঝেসাজে এ বিষয়ে আমায় জ্ঞান দেবার চেষ্টা করেছেন তবে বিশেষ কাজ হয়নি। কি করব, টিপিকাল বাঙালি বাবুর মত লুঙ্গি পরে সকালবেলা এক হাতে বাজারের থলে নিয়ে মাছের কানকো তুলে তার দোষ-গুণ সহ চৌদ্দগুষ্টির হিস্ট্রি খুঁজে আমি বের করতে পারিনা। অগত্যা যা হবার তাই হয়! তা সেদিন বাড়ী ফেরার পথে নদীর পাড়ে এক জেলের কাছে বেশ কমদামে বড়সড় একখানা লোকাল কাতলা মাছ পেয়ে গিয়েছিলাম, সাথে সহৃদয় এক ব্যক্তির দেখাও পাই যিনি সে মাছের ওই কানকো টানকো দেখে সার্টিফাই করে দিয়েছিলেন যে ও একদম এক নম্বর মাছ। তাই এক হাতে মাছ নিয়ে ঝোলা কাঁধে বেশ ফুরফুরে মনে বাড়ি ফিরছিলুম যে গিন্নীর কাছে আজ বেশ দর বাড়ানো যাবে। এসব ভাবতে ভাবতে অন্ধকার পথ দিয়ে বাড়ি ফিরছি হঠাৎ অনুভব করলুম কে যেন আমার পেছু নিয়েছে। থেমে গিয়ে পেছন ঘুরলুম-

 

আমি - কে আসছে পেছনে?

 

(কোনও উত্তর নেই)

 

আমি - আবার বলছি, কে আসছে পেছনে? ভালো হবে না কিন্তু বলে দিলুম।

 

(কোনও উত্তর নেই)

 

আমি - (ভাবলুম) তবে বোধহয় মনের ভুল।

 

(আবার পথ চলা শুরু করলুম, এবারে খানিকক্ষণ পর মাছের থলিখানা কে যেন টানতে লাগলো)

 

আমি - (ভাবলুম) কে আবার ব্যাগ টানে বাপু? চোর-ডাকাত হলে তারা তো মাছের থলি টানে বলে শুনিনি! উঁহু, এ তো অন্যরকম মনে হচ্ছে! গন্ধটা সন্দেহজনক!

(বললুম) কে বাপু থলে টানছো? ওতে টাকা পয়সা কিছুই নেই। শুধু একটা মাছ...

 

মেছোভূত - (অন্ধকার থেকে আওয়াজ আসে) ওরে আমায় একটু মাছ দিবিনে?

 

আমি - (ভাবলুম) মাছ চাইছে! এ তো মেছোভূত মনে হচ্ছে! না, একটু খেলিয়ে দেখি।

(বললুম) কে তুমি হে, কোনও মেছোভূত নাকি?

 

মেছোভূত - (অদৃশ্য থেকেই) তা ভুল বলিসনি। মাছ খেতে আমার বেজায় ভালো লাগে। হ্যাঁরে, তা আমায় একটু মাছ দিবিনে? বেজায় সুভাষ ছাড়ছে।

 

আমি - হ্যাঁ, তা তোমার দৃষ্টি যখন এতে পড়েছে, দিতে হবে বৈকি! কিন্তু দেবটা কাকে? কাউকেই যে দেখতে পাইনে! সামনে এসে দেখা দাও, তবে না দিতে পারি।

 

(অন্ধকার থেকে ধীরে ধীরে একজন লোক এগিয়ে এলো- খুবই লম্বা, বেজায় রোগা, হাত পা গুলো কাঠি কাঠি, কি পরে আছে বোঝা যাচ্ছে না)

 

মেছোভূত - নে, আসলুম, ভয় পাসনি, কিছু করবনাকো। দে, এবারে একটু মাছ দে রে বাবা।

 

আমি - শোনো, একটু নয়, তোমায় আমি গোটা মাছটাই দিয়ে দিতে পারি, কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।

 

মেছোভূত - গোটা মাছ? দিবি? দিবি? দিবি? বল, বল, কি করতে হবে? কি করতে হবে?

 

আমি - তেমন কিছু না, আমি তোমার এক ইন্টারভিউ নিতে চাই। মানে আমি তোমায় কিছু প্রশ্ন করব, তুমি ঠিক ঠিক তার জবাব দেবে। ব্যস্‌, তাহলেই আমি তোমায় এই গোটা মাছখানা দিয়ে দেবো। বলো রাজি?

 

মেছোভূত - রাজি। রাজি। রাজি। খুব রাজি। ওরে বাবা, একটা গোটা মাছ! বল, বল, কি প্রশ্ন বলবি বল।

 

আমি - এখানে নয়, চলো কোথাও গিয়ে বসা যাক।

 

(পথের ধারে একখানা গাছের তলায় দুজনে গিয়ে বসি)

 

আরও পড়ুন - বাংলা মজাদার নাটক 'চিতেন চোর'

অথবা পড়ুন - সামাজিক অবস্থা নিয়ে লেখা সুন্দর কবিতা ‘গাছের মত অত্যাচারিত মানুষ’


মেছোভূতের দেখা পাওয়া



আমি - শোনো, তুমি এক কাজ করো, মাছখানা নিয়েই নাও। তুমি যেমন ছোঁক ছোঁক করছো, নইলে তোমার ধৈর্যে কুলোবে না।

 

মেছোভূত - দে! দে! দে! দে! দে!

 

(মাছটা পেয়েই মেছোভূত হাপুস-হুপুস করে পুরো মাছটা খেয়ে ফেলে, একটু কাঁটাও অবশিষ্ট থাকে না)

 

আমি - এবারে বলো তোমার নাম কি?

 

মেছোভূত - হেঁ- হেঁ- হেঁ- আমার আবার নাম কি? মেছোভূত রে, মেছোভূত। আমাদের আলাদা কোনও নাম হয়না। কখনো ভূতেদের এমন নাম শুনেছিস- কালু মামদো, রাজু ব্রহ্মদত্তই, গবা মেছো অথবা রানী শাকচুন্নি? আমাদের নাম ওই ক্লাস দিয়েই বিচার করা হয়, আলাদা নাম থাকে না।

 

আমি - আচ্ছা, আচ্ছা, বুঝলাম, বুঝলাম। একটা প্রশ্নের উত্তর দাও, তুমি মেছোভূত হলে কি করে? মানে সবাই তো আর মারা গেলেই মেছোভূত হয় না, তুমি কেন হলে?

 

মেছোভূত - শোন, জীবদ্দশায় আমি থাকতুম ভেড়ভেড়ী গাঁয়ের এক কোণে এক ছোট্ট ঝুপড়িতে। তিনকূলে কেউ ছিলনা আমার, আমি একাই থাকতুম। আর কোনও নেশা-ভাংও করতুম না, থাকার মধ্যে নেশা ছিল দুটোই- মাছ ধরা আর মাছ খাওয়া, মাছ খেতে আমি খুব ভালবাসতুম। একদিন খবর পেলুম পাশের গাঁয়ের লালদীঘিতে বড় বড় মাছ ঘাই দিচ্ছে, ব্যাস্‌, ছিপ বড়শি নিয়ে চলে গেলুম। সেই দিনটা ছিল ভয়ের- মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছিল, সাথে বড় বড় বাজ। তা সত্বেও ছিপ নিয়ে গেলুম বসে। হঠাৎ কোথাও এক বিশাল বাজ পড়ল, তারপর আর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরল দেখি পাশে আমার মরা শরীরটা। ব্যস্, তখন থেকে আমি মেছো। কেন হলুম, অন্য কিছু হলুম না কেন, অতশত জানিনা বাপু।

 

আমি - আচ্ছা, বেশ, বুঝলুম। এবারে বলো তোমার মানুষ জীবন বেশি ভালো ছিল নাকি এই ভূত জীবন?

 

মেছোভূত - ভুত- ভুত- ভুত- ভুত জীবন।

 

আমি - কেন?

 

মেছোভূত - ছ্যাঃ ছ্যাঃ ওটা আবার একটা জীবন ছিল? হেথা যাবিনে, হোথা যাবিনে; এই কবিনে, ওই কবিনে; এই খাবিনে, ওই খাবিনে; এই করবিনে, ওই করবিনে; কত শত ঝামেলা, কত শত জ্বালা! এখনই দিব্যি আছি- বাধা নেই, নিষেধ নেই, কেউ বেশি কথা কইতে এলে মট্‌ করে দাও ঘাড় মটকে, ঝামেলা শেষ!

 

আমি - ওরে বাবা রে! তা তুমি কোন মাছ খেতে পছন্দ করো?

 

মেছোভূত - ওরে আমি মেছোভূত রে, মেছোভূত। আমি কোন মাছটা খাই না তাই বল। সব খাই, যে মাছই পাই, কপাৎ করে খেয়ে নিই। চেয়ে খাই, কেড়ে খাই, চুরি করে খাই, না পেলে ধরেই খাই- তবে ভাজাটা খেতে সবচাইতে ভালো লাগে, আহা! আহা!

 

আমি - আচ্ছা, এরপর কি করবে? মানে আমি চলে যাবার পর?

 

মেছোভূত - কেন, মাছ খুঁজতে বেড়োব!

 

আমি - এই গোটা মাছটা খাবার পরও আবার?

 

মেছোভূত - ধুশ্‌! ওরে, এ তো নশ্যি! আরও কত খেতে পারি।

 

আমি - ঠিক আছে, তবে আমার কথা শেষ। তুমিও যাও, আমিও বাড়ি যাই।

 

মেছোভূত - আচ্ছা বেশ।

 

(মেছো ভূত অদৃশ্য হয়, আমিও গিন্নিকে আর মাছ দিয়ে দর বাড়াতে পারলুম না একথা ভাবতে ভাবতে বাড়ির পথে এগোলুম।)

 

আরও পড়ুন - নানারকমের হাসির প্রকারভেদ নিয়ে রম্যরচনা ‘হাসি ক্লাসিফিকেশান’

অথবা পড়ুন - বিবাহিত পুরুষদের জন্যে লেখা একটি রম্যগল্প ‘রমণে? বুঝিবে শমনে’


<<Previous Article            <Main Introductory Page>            Next Article>>

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন